অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আসন্ন রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে আমরা সবার সহযোগিতা চাই। আমরা ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাদের কাছে ওয়াদা করেছে বাজারে পণ্য সরবরাহের কোনো সংকট হবে না। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে যদি কেউ কৃত্রিম কোনো সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করে আমরা তাকে কঠোর হাতে দমন করব। বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে বিকল্প কৃষি বাজার চালু করার লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) সকাল ১০টায় মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এসব কথা বলেন তিনি। জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার এই ভাষণ একযোগে সম্প্রচার করে বিটিভি ও বিটিভি ওয়ার্ল্ড।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার এখনো কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না পাওয়ার কথা স্বীকার করেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, গত কয়েক মাসে বাজারে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। আমরা সরবরাহ বাড়িয়ে, আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়ে, মধ্যস্বত্ব ভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে এবং বাজার তদারকির মধ্য দিয়ে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি এখনো পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। এটা সম্ভব হলে আমরা আশা করি জিনিসপত্রের দাম আরও কমে আসবে। আমরা আপনাদের কষ্টে সমব্যথী। তবে আমরা জানি সরকারের কাজ কেবল সমবেদনা জানানো নয়। আমরা আপনাদের কষ্ট কমিয়ে আনতে সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
বিগত সরকারের আমলে দেশের ব্যাংক খাতে অনিয়মের ব্যাপারে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে অর্থনীতি তখন ভেঙে পড়ার অবস্থায়। গত চার মাসে এই অবস্থার বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা এবং নিয়ম শৃঙ্খলা ফিরে আসছে। কোনো ব্যাংক বন্ধ করে দিতে হয়নি। ব্যাংক যতই দুর্বল হোক তাকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদন সম্পর্কে সরকারপ্রধান বলেন, এই রিপোর্ট পড়ে দেশের মানুষ হতভম্ব হয়ে গেছে। ফ্যাসিবাদী সরকার দেশের অর্থনীতিকে ভেঙে দিয়ে গেছে এটা সবাই বুঝতে পারছিল। কিন্তু অর্থনীতিকে কী পরিমাণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিয়ে গেছে তার পরিমাপ সম্বন্ধে কোনো ধারণা করতে পারছিল না। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি হিসাব-নিকাশ করে এর পরিমাণ বের করে দিয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এই রিপোর্ট পড়ে সবাই অবিশ্বাস্য চোখে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। কারো মুখে কথা বের হচ্ছে না। দিন-দুপুরে সবার সামনে থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে পাচার করে নিয়ে গেছে। কেউ বলার ছিল না। কেউ দেখার ছিল না। যারা নিয়ে গেছে তাদের কেউ বাধা দেয়নি। বরং সর্বস্তরে সবাই আগ্রহ সহকারে তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। কারণ তারা সব আপন লোক। বিশাল বিশাল প্রকল্প নেওয়া হয়েছে ঋণের টাকায়। এসব প্রকল্পের মোড়কে বিশাল বিশাল অর্থ লুটপাট করেছে। প্রকৃত ব্যয়ের চাইতে কত বেশি ব্যয় ধরে কাদের হাতে টাকাটা পাচার করে দেওয়া হয়েছে তাও এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে তিনি আরও বলেন, বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক টাকাই লুটপাট হয়েছে। দেশে এমন ধরনের পোষ্যতোষী পুঁজিবাদ তৈরি করা হয়েছিল যার সুবিধাভোগী ছিল স্বৈরাচার ও তার সহযোগীরা। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে যে পরিমাণ কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, সেটা অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে দেশের শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ, স্বাস্থ্য বাজেট তিনগুণ করা সম্ভব ছিল। পাচার করা এই টাকা আপনাদেরই টাকা। তারা প্রকাশ্যে আপনাদের কষ্টার্জিত অর্থ লুট করে বিদেশে ভোগ-বিলাসে ব্যয় করেছে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, সম্প্রতি গার্ডিয়ান পত্রিকাতেও পাচার করা টাকায় গড়ে তোলা সম্পদের পাহাড় নিয়ে একটা সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। পাচার করা এই সীমাহীন অর্থ এখন আবার দেশে গোলযোগ সৃষ্টি করে তারা এ দেশে ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টির কাজে ব্যয় করছে। আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন এ টাকা কীভাবে দেশের সংহতির বিরুদ্ধে সকল প্রকার অপপ্রচারের কাজে লাগানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রতি বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে হার দেখানো হয়েছে সেটাও মনগড়া। দেশকে এবং পৃথিবীকে বলা হচ্ছিল কী সুন্দর দেশ বাংলাদেশ, লাফিয়ে লাফিয়ে তার উন্নয়ন এগিয়ে চলছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় কাজ হলো পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা। তারা তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে সেটা চেষ্টা করছে। কাজটা কঠিন, কারণ এ বিষয়ক আইন কঠিন। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে সাহস ও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। বারবার বলছি অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আংশিক টাকা হলেও যেন ফেরত আনা যায়।
বিজয়ের মাসে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমি বাংলাদেশের দল, মত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। শক্তিশালী স্বৈরাচারী সরকারকে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমেই আমরা হটাতে পেরেছি। তারা এখনো সর্বশক্তি দিয়ে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যকে নস্যাৎ করতে চাচ্ছে, একের প্রতি অন্যের বিষ উগড়ে দিতে চাচ্ছে। তাদের এই হীন প্রচেষ্টাকে কোনোভাবেই সফল হতে দেবেন না।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিজয়ের মাস হোক নাগরিকদের পরস্পরের মধ্যকার সম্পর্ক স্থায়ীভাবে ভয়বিহীন থাকবে এমন এক সমাজ গড়ার মাস, সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভয়ে ভীত হতে হবে না, নারীকে পুরুষের ভয়ে ভীত হতে হবে না, বিত্তহীনকে বিত্তবানদের ভয়ে ভীত হতে হবে না, নিজের মতপ্রকাশে কারো ভয়ে ভীত হতে হবে না।
মন্তব্য করুন