আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, দুদক ও বিচার বিভাগ শেখ হাসিনার দাসে পরিণত হয়েছিল, যে কারণে দুর্নীতি লাগাম ছাড়ালেও এর কোনো বিচার হয়নি।
সোমবার (৯ ডিসেম্বর) সকালে রাজধানীর কাকরাইলে আইডিইবি মিলনায়তনে ‘আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস-২০২৪’ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
দুর্নীতির বিচার না হওয়ার সংস্কৃতির কথা তুলে ধরে আসিফ নজরুল বলেন, দুর্নীতি যে একটা খারাপ জিনিস এটা ভাবার সংস্কৃতি আমাদের সমাজ থেকে চলে গেছে। গত ১৫ বছরে আমরা দেখেছি, ১০০ টাকার বালিশ নাকি চার হাজার, পাঁচ হাজার টাকায় কেনা হয়েছে। আমরা দেখেছি, ৬টা ব্যাংক লুট হয়েছে। বাংলাদেশের একজন সাধারণ ব্যবসায়ী সিঙ্গাপুরে সবচেয়ে বড় লোক হয়ে গেছে। আমরা দেখেছি, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছে, এটা হাসতে হাসতে তিনি জাতির সামনে বলছেন।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়া ৩ কোটি টাকা এক জায়গায় রেখেছিলেন। একটা টাকাও সেখান থেকে তিনি আত্মসাৎ করেনি। বরং ৩ কোটি টাকা ৬ কোটি টাকা হয়েছে। ওই টাকা কেউ স্পর্শও করেনি। এই টাকা রাখার প্রক্রিয়াগত ভুলের কারণে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ১০ বছরের জেল দিয়েছে এই দেশের দুদক ও বিচার বিভাগ মিলে। আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে বলে বেড়াতেন এতিমের টাকা নাকি খালেদা জিয়া আত্মসাৎ করেছেন।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময়ে দুদক সংস্কার হয়েছে, বারবার সংস্কারের মাধ্যমে এটিকে ক্ষমতায়িত করা হয়েছে। কিন্তু গত ১৫ বছরে শুধু দুর্নীতিই দেখা গেছে। দুদক তো ছিল, উচ্চ আদালতও ছিল, তাহলে দুর্নীতির বিচার কেন হয়নি? কারণ, কেউ তার (শেখ হাসিনা) সামনে কিছু বলতে পারেনি। এ কারণে দুদক, বিচার বিভাগ তার দাসে পরিণত হয়েছিল।
এ সময় উপস্থিত দুদক কর্মকর্তাদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, এখন তো সময় পরিবর্তিত হয়েছে, কেউ কোনো রকম হস্তক্ষেপ করছে না। প্রায় শতাধিক মন্ত্রী, ব্যবসায়ী গত আমলে চুরি করে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। আপনারা এখন সেগুলোর তদন্ত করে দেখিয়ে দিন যে, ভালো পরিবেশ পেলে আপনারা কাজ করতে পারেন। দেখিয়ে দিন যে, তাদের দুর্নীতি আপনাদের হৃদয় ও বিবেককে দূষিত করতে পারেনি। আর এটাই আপনাদের কাছে এখন সারা দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা। তিনি আরও বলেন, কেবল রাজনীতিবিদদের দোষ দিয়ে আমরা যেন নিজের অন্যায় থেকে নিজেকে পার পাওয়ার চেষ্টা না করি।
অনুষ্ঠানের বাইরে এসে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, যেসব কাজ বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সাহায্যে করা সম্ভব, সেগুলো আমরা করে ফেলব। আমরা দেরি করব না, আমাদের খুব বেশি সময় নেই।
তিনি বলেন, বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি। আমি তাদের বলেছিলাম, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য আমরা একটা আইন করব, আপনারা আইনটির খসড়া করে দিতে পারবেন কি না। এর পরিপ্রেক্ষিতে তারা কমিশনের রিপোর্ট ছাড়াই আমাদের আইনটির খসড়া তৈরি করে দিয়েছেন।
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন ও প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে দুটি আলাদা আইনের খসড়া পাওয়া গেছে জানিয়ে আসিফ নজরুল বলেছেন, এই দুটি আইন অবলম্বনে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত আইনটি যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করা হবে।
দুদক কমিশন নিয়োগ প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা বলেন, দুদকের ব্যাপারটা আমি দেখছি না। যারা দেখছেন বা যিনি দেখছেন, তারা এ বিষয়ে সচেতন আছেন। দুদককে অচল রাখা যাবে না। এত বড় বড় দুর্নীতি হয়েছে, দুদককে অবশ্যই সচল করতে হবে।
বিচার না হওয়ায় দুর্নীতি সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুদকের সাবেক কমিশনাররা পদত্যাগের আগে শতাধিক (প্রায় দুশর মতো) বড় বড় মন্ত্রী, এমপির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান বা তদন্তের অনুমোদন দিয়ে গেছেন। এসব বিষয়ে দুদক কি কাজ করছে, সাংবাদিকদের সে বিষয়ে অনুসন্ধান অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি।
একাত্তর ও জুলাই-আগস্টের শহীদদের আত্মত্যাগের মহিমা সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের সন্তানরা নিজেদের রক্ত দিয়ে নতুন সময় আমাদের উপহার দিয়ে গেছে। আসুন, আমরা তাদের কাছ থেকে শিখি, বিবেককে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতি থেকে দূরে থাকি ও তাদের প্রত্যাশার প্রতি শ্রদ্ধাবান থাকি।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ও দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান।
মন্তব্য করুন