ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে ‘মিথ্যা’ অপপ্রচার বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্ট দাবি করে বলেছে, সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্য সব দেশের জন্য অনুকরণীয়। বর্তমান সরকারের আমলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নাগরিকরা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ও সমঅধিকার নিয়ে বসবাস করছে।
বৃহস্পতিবার (০৫ ডিসেম্বর) বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিজন কান্তি সরকার এ দাবি করেন। ভারতীয় গণমাধ্যম ও ধর্মান্ধ রাজনৈতিক কিছু ব্যক্তির বাংলাদেশবিরোধী মিথ্যা অপপ্রচার এবং ভারতীয় ‘উগ্রবাদীদের’ বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্ট।
বিজন কান্তি সরকার বলেন, দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরাচারী একদলীয় অপশাসনের পর দেশ যখন স্বাধীন-সার্বভৌম সত্তা নিয়ে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে চলছে, তখনই পতিত স্বৈরাচারের প্রেতাত্মার ইন্ধনে পার্শ্ববর্তী দেশের গণমাধ্যম ও স্বার্থান্বেষী ধর্মান্ধ কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিদের নিয়ে বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মুসলিম ও সরকারকে বিশ্ব দরবারে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশন ভাঙচুর করছে, প্রধান উপদেষ্টার কুশপুত্তলিকা দাহ করছে এবং নানা রকম অশালীন, অযৌক্তিক ও বানোয়াট মন্তব্য করা হচ্ছে। আমরা ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের এ সমস্ত প্রোপাগান্ডা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানাই। ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণকে বুঝার চেষ্টা করুন। পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতা বজায় রেখে উভয় দেশের জনগণের কল্যাণে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করুন। কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতি অনুরক্ত না হয়ে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করুন। গণমাধ্যম এবং ধর্মান্ধ- সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মিথ্যা প্রোপাগান্ডা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখুন।
তিনি আরও বলেন, প্রকৃত তথ্য হলো- বাংলাদেশে যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, তখনই হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নাগরিকরা বিপদে পতিত হয় এবং সর্বক্ষণ আতঙ্কিত থাকে, নানা আকারে-প্রকারে নির্যাতিত-লাঞ্চিত হয়। পাশাপাশি অন্যান্য সরকার বা দলের সময়ে হিন্দু তথা সংখ্যালঘু জনগণ শান্তিতে-সম্প্রীতিতে জীবন নির্বাহ করেছে, বিশেষ করে বর্তমান সরকারের আমলে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ও সমঅধিকার নিয়ে বসবাস করছে।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের এই চেয়ারম্যান বলেন, আওয়ামী সরকার একদিকে ক্ষমতার জন্য দিল্লি তোষণ করে, অপরদিকে দেশে হিন্দু নির্যাতন চালায়। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিন্নমতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর সম্পত্তি, দেবোত্তর সম্পত্তির অধিকাংশ আওয়ামী কর্মীদের অবৈধ দখলে। মন্দির ভাঙচুর, নারী নির্যাতনে নেতৃত্বদানকারী ৯৮ শতাংশ আওয়ামী নেতাকর্মী। বাংলাদেশে যত মন্দির পোড়ানো হয়েছে, তার ১০০% পুড়িয়েছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। এমনকি আওয়ামী সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে ও ইন্ধনে হিন্দুদের বাড়িঘর পোড়ানো হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার প্রভাবে সংবাদ মাধ্যমে জামায়াত-বিএনপি কর্মীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়। ভারতীয় মিডিয়াও আওয়ামী অনৈতিক অপপ্রচারে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে সম্পৃক্ত হয়, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ কখনো কোনো নির্যাতন-দখলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি, বিচার করেনি। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্য দিবালোকে দর্জি দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করে। কিন্তু শেখ হাসিনা এ হত্যার কোনো বিচার করেনি। আওয়ামী প্রচার সেল নিত্যদিন মিথ্যা অপপ্রচার করে, মিথ্যা গল্প বানায়। প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ একটি হিন্দুবিদ্বেষী দল। শেখ মুজিব নিজে কখনো হিন্দুদের সম্মান দেননি। ভারতের একচোখা নীতির কারণে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিপদগ্রস্ত হয় উল্লেখ করে বিজন সরকার বলেন, ভারত ও ভারতীয় জনগণের একাংশ আওয়ামী প্রোপাগান্ডায় বিভ্রান্ত হয়ে ‘প্রকৃত বন্ধু’ বাংলাদেশের জনগণকে শত্রু বানিয়ে ‘আসল শত্রু’ আওয়ামী লীগ ও শেখ পরিবারের প্রতি অন্ধ অনুসারী হয়েছে। ভারতীয় জনগণ, গণমাধ্যম ও দিল্লি সরকারের প্রতি আমাদের আহ্বান- প্রকৃত বন্ধুকে চিনে নিন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশের সব ধর্ম-মতের জনগণকে আস্থায় নিন। বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী উভয় দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান রেখে ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রার পথকে মসৃণ করুন। আওয়ামী স্বৈরাচারের পতনের পর এখনই সময় ঢাকা-দিল্লি পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করা এবং পারস্পরিক বিশ্বাস-আস্থা গভীর করার। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সে লক্ষ্যেই কাজ করছে।
ভারত সরকার ও মিডিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সব ধরনের মিথ্যা প্রোপাগান্ডা প্রচার থেকে ভারতের মিডিয়া এবং ধর্মান্ধ রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে বিরত রাখতে হবে। কোনো ধর্ম-বর্ণ-জাতিগোষ্ঠীর ভিত্তিতে নয়, প্রতিবেশী দেশের মানুষের সাথে সম্পর্কের ভিত্তি হবে মানবতা। বাংলাদেশ-ভারত উভয়ই স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। উভয় দেশের পারস্পরিক স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি সুরক্ষা ও সম্মান নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের কোনো নির্দিষ্ট দলের বা মতের প্রতি অযৌক্তিক আনুকূল্য প্রদর্শন থেকে ভারত সরকারকে বিরত থাকতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের সম্প্রীতি বিনষ্টের লক্ষ্যে ভারতীয় সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদীদের সব অপকৌশল বন্ধ করতে হবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিজন কান্তি সরকার বলেন, ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজেদের রাজনীতির স্বার্থে বাংলাদেশের হিন্দুদের ব্যবহার করছে। আমরা তাদের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছি, বলির পাঁঠা হচ্ছি। ভারত কার্যত বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কোনো সহায়তা করে না। এ ব্যাপারে আমাদের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নাগরিকদের সচেতন হতে হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি তারা পর্যবেক্ষণ করছেন। চিন্ময় ব্রহ্মচারী ইসকনের কেউ না, হিন্দুরা বিভ্রান্ত হয়েছে। তাদের বোঝানো হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের মহাসচিব তরুণ দে, কেন্দ্রীয় নেতা অপর্ণা রায় দাস, তপন মজুমদার, রণজিৎ রায়, সুশীল বড়ুয়া, রমেশ দত্ত, মিল্টন বৈদ্য, দুলাল রায়, সত্যজিৎ কুন্ডু, জনি দেব, আনন্দ সাহা, সুভাস চন্দ্র দাস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মন্তব্য করুন