দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার ঢাকা ও চট্টগ্রাম কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ এবং প্রথম আলোর রাজশাহী ও বগুড়া কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন ৩১ নাগরিক। একইসঙ্গে তারা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষায় সরকারসহ সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা এ আহ্বান জানান।
বিবৃতিতে তারা জানান, আমরা গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, গত ২৫ নভেম্বর (সোমবার) দুপুরে দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকা বন্ধের দাবিতে ‘আলেম ওলামা ও তাওহীদি জনতা’র ব্যানারে রাজশাহীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে বিক্ষোভের নামে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও প্রথম আলো অফিসের সাইনবোর্ড ভাঙচুর করা হয়। ঐদিন রাতে বগুড়ার জলেশ্বরীতলায় প্রথম আলোর আঞ্চলিক কার্যালয় লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছোড়ে এবং কার্যালয়ের ডিজিটাল সাইনবোর্ড ভাঙচুর করে ১৫-১৬ হেলমেট ও মুখোশধারী হামলাকারী। এর আগে গত ২১ নভেম্বর থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে পত্রিকা দুটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এবং গত ২৪ নভেম্বর ঢাকার কারওয়ানবাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে ‘বাংলাদেশের জনগণ’ ব্যানারে গরু জবাই করার কর্মসূচি ও বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি দেয় বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভকারীদের একাংশের দাবি ছিল- ‘প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার ভারতীয় আগ্রাসনে সহায়তা করছে। ফলে তাদের তওবা করার জন্য এ জিয়াফত কর্মসূচি। এখানেই রান্না করে সবাইকে খাওয়ানো হবে।’ সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের এ কর্মসূচি চলে। এরপর পুলিশ তাদের চলে যেতে বললে তারা আপত্তি জানায়। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে তাদের বাক-বিতণ্ডা এবং ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে, সংবাদকর্মীসহ ওই স্থানের অন্যদের জন্য ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।
বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর এহেন ধৃষ্টতাপূর্ণ সহিংস আক্রমণ ও সন্ত্রাসী তৎপরতা শুধু দুটি স্বনামধন্য দৈনিকের ওপর নয়, সমগ্র সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ এবং সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই- স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার সবার আছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কোনো খবর বা প্রতিবেদনের বিষয়ে অভিযোগ থাকলে সেটির জন্য যথাযথ আইনানুগ কিংবা গঠনমূলক প্রক্রিয়া অবলম্বন না করে পত্রিকা বন্ধ করার জন্য বিক্ষোভ ও হামলার বিষয়টি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের একাংশের অভিযোগ হলো- ‘ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের জঙ্গি বানানোর কারিগর হিসেবে কাজ করে।’ এটি একটি গুরুতর অভিযোগ এবং কিসের ভিত্তিতে তারা এ অভিযোগ করছেন সেটি বোধগম্য নয়। কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের ঢালাও অভিযোগ, উসকানি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্বেষ ছড়ানোর পেছনে কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের দুরভিসন্ধি রয়েছে কিনা তা যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা জরুরি।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, যে দুটি পত্রিকাকে লক্ষ করে উসকানি ও বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, সে দুটি পত্রিকা সদ্যপতিত স্বৈরাচারী সরকারের আমলেও নানাভাবে মামলা ও হয়রানিসহ শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে কালো তালিকাভুক্ত হয়েছিল। পত্রিকা দুটির সম্পাদকদ্বয়ের বিরুদ্ধে বিগত সরকারের দলীয় কর্মীরা কয়েক ডজন হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করেছিলেন। স্বৈরশাসন অবসানের পর সমাবেশ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার সুযোগকে অপব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক উসকানি ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরির মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করার উদ্দেশ্যের অংশ হিসেবে এ দুটি পত্রিকার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এবং হামলার ঘটনাগুলো ঘটছে বলে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এছাড়া নতুন করে একটা ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টির অপচেষ্টাও দৃশ্যমান। কাজেই সরকারের প্রতি আমাদের আহ্বান, বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের মাধ্যমে উসকানিদাতা ও তাদের ইন্ধনদাতাদের দ্রুত শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। গণমাধ্যম কার্যালয়ে ভাঙচুরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যে অঙ্গীকার তথ্য উপদেষ্টা ব্যক্ত করেছেন সেটিকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে এ ঘটনাগুলোর উসকানিদাতা ও ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াও জরুরি। আমরা একই সঙ্গে জনগণকে যে কোনো ধরনের উসকানি ও বিভ্রান্তি থেকে সতর্ক থাকা এবং সংবাদমাধ্যমের সুরক্ষায় ঐকবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।
বিবৃতিতে দিয়েছেন- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ, কামাল, মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল, নিজেরা কর’র সমন্বয়কারী খুশী কবিরসহ অন্যরা।
মন্তব্য করুন