রোড ক্র্যাশে হতাহতের যে তথ্য বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এর সংখ্যার যেমন তারতম্য রয়েছে, তেমনি পার্থক্যও রয়েছে গুণগত মান নিয়ে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও মানুষের মৃত্যু এবং আহত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ রোড ক্র্যাশ। যা দেশের স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতির ওপর বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
মঙ্গল ও বুধবার (১২-১৩ নভেম্বর) দুদিনব্যাপী রাজধানীর একটি হোটেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আয়োজনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সার্বিক সহায়তায় ‘রোড ক্র্যাশ তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক একটি কর্মশালায় আলোচকরা এ মন্তব্য করেন।
এ ছাড়াও কর্মশালার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম (এনসিডিসি), সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এবং আরটিআই প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ ইউনিট। কর্মশালার প্রথম দিনে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশ্ব স্বাস্থ্য উইং অতিরিক্ত সচিব শেখ মোমেনা মনি। বিশেষ অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের বিশ্ব স্বাস্থ্য উইং এর যুগ্ম সচিব মামুনুর রশীদ। কর্মশালার উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর, এনসিডিসি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ জাকির হোসেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপপ্রতিনিধি ড. রাজেশ নারওয়াল। স্বাগত বক্তব্য দেন সিআইপিআরবির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. এ কে এম ফজলুর রহমান।
২০২৫ সালের মধ্যে রোড সেফটি বিষয়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহের জন্য কম্প্রিহেনসিভ ডাটাবেইজ তৈরি করা, তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি, রোড ক্র্যাশসংক্রান্ত সার্ভিলেন্স সিস্টেম তৈরি, প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেদনের বাইরে সংঘটিত হওয়া রোড ক্র্যাশে আহত ও নিহত ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি নির্ধারণ করা, জাতীয় পরিকল্পনায় রোড ক্র্যাশের তথ্য সংগ্রহের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, রোড ক্র্যাশজনিত কারণে মৃত্যুর সংজ্ঞা নির্ধারণ করা, সর্বোপরি রোড ক্র্যাশ তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি লিড এজেন্সি নির্ধারণ করার উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ সুপারিশমালার আলোচনায় উঠে আসে।
শেখ মোমেনা মনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার চালক, পথচারী এবং সাইক্লিস্টদের জন্য সড়ককে নিরাপদ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। তিনি আরও বলেন, রোড ক্র্যাশবিষয়ক তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির ত্রুটিসমূহ দূর করতে প্রয়োজনীয় সবধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হবে।
আলোচনায় সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, অপরীক্ষিত ও বহুমুখী সূচকের ব্যবহার, তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতির ভিন্নতা, পরীক্ষামূলক প্রকল্পের আওতায় ভিন্ন ভিন্ন ডাটাবেজ তৈরি, যথাযথ তথ্য বিশ্লেষণের অপ্রতুলতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য কারণগুলো উঠে আসে।
বক্তারা বলেন, সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে সড়ক নিরাপত্তাকে জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং কার্যকর কর্ম-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।
রোড ক্র্যাশে বিশ্বে প্রতিবছর ১১ লাখ ৯০ হাজার মানুষ মারা যায়। প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ আহত হয়। যা প্রতি মিনিটে দুজন ও প্রতিদিন ৩২০০ জনের বেশি। যাদের বেশিরভাগই শিশু এবং উপার্জনক্ষম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৩ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটিতে এ তথ্য জানা যায়।
মামুনুর রশীদ বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে রোড ক্র্যাশবিষয়ক রেজুল্যুশন নেওয়া হয়েছে। চলতি দশককে ‘ডিকেড অফ অ্যাকশন ফর রোড সেফটি ২০২১-৩০’ ঘোষণা করা হয়েছে। যাতে বাংলাদেশ সরকার একাত্মতা প্রকাশ করে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে।’
ড. রাজেশ নারওয়াল বলেন, ‘সড়ক নিরাপত্তা বিষয়টি নিশ্চিত করা একক কোনো প্রতিষ্ঠানের কাজ নয়। এটি নিশ্চিত করতে দরকার সংশ্লিষ্ট সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সরকারের এই উদ্যোগের সাথে সংযুক্ত হতে পেরে আনন্দিত।’
অধ্যাপক ড. এ কে এম ফজলুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের সড়ককে জনসাধারণের জন্য নিরাপদ করতে সঠিক ও গুণগতমান সম্পন্ন তথ্য ও যথাযথ পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই।’
দুদিনব্যাপী বিভিন্ন অংশগ্রহণকারী সংস্থা- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদর দপ্তরের বিশেষজ্ঞরা, বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), মেডিকেল ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিআইপিআরবি, থাইল্যান্ড সরকারের প্রতিনিধিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের রোড ক্র্যাশবিষয়ক তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি উপস্থাপন করেন।
অধ্যাপক ডা. সৈয়দ জাকির হোসেন সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে কর্মশালার সমাপ্তি ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে কর্মশালাশুদ্ধ সুপারিশমালাসমূহ রোড ক্র্যাশবিষয়ক তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে সমৃদ্ধ করতে যথার্থ ভূমিকা পালন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এ লক্ষ্যে তিনি সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে সক্রিয় অবদান রাখার আহবান জানান।
মন্তব্য করুন