কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল তাড়াতাড়ি, কিন্তু ফিরল লাশ হয়ে

শহিদ সাহাদাত হোসেন। ছবি : সংগৃহীত
শহিদ সাহাদাত হোসেন। ছবি : সংগৃহীত

বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় বলেছে, নানু আমি খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসব। নানু আমার ফিরেছে, কিন্তু লাশ হয়ে। শেষবারের মতো আর কথা হয়নি নাতির সঙ্গে। পারিবারিক কারণে ছোটবেলা থেকে অবহেলিত নাতি আমার শেষ পর্যন্ত আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেল ওপারে। মমতাজ বেগম কাঁদতে কাঁদতে এসব কথা জানান।

বলছিলাম শহিদ হন সাহাদাত হোসেনের (১৬) কথা। চলতি বছরের ৫ আগস্ট বিকেলে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থানার সামনে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন সাহাদাত হোসেন। ছোটবেলা থেকেই নানার বাড়িতে বড় হয়েছেন এ কিশোর। ওই বাড়ির সামনে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাহাদাতের মা শিরতাজ বেগমের সঙ্গে প্রথমে বিয়ে হয় বরিশালের খলিলুর রহমানের। বিয়ের পর থেকেই বাবার বাড়িতেই থাকতেন শিরতাজ। পরে কাজের জন্য চলে যান ঢাকা। সাহাদাতের জন্ম হয় নানাবাড়িতে। পারিবারিক কলহের কারণে স্বামী শিরতাজকে ছেড়ে চলে যায়। পরে কয়েক বছর অপেক্ষা করে স্বামীকে তালাক দেন শিরতাজ। এরপর আবার বিয়ে হয় লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার বাসিন্দা আমির হোসেনের সঙ্গে। আমির হোসেন পেশায় কবিরাজ। শিরতাজ বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে থাকতে শুরু করেন।

যে কারণে নানা বাড়িতেই বেড়ে উঠেছে সাহাদাত।

সাহাদাত নানি মমতাজ বেগম বলেন, শিরতাজ আমার মেয়ে। নাতির জন্ম হয়েছে আমাদের বাড়িতে। সাত বছর বয়সে তাকে চাঁদপুরে একটি কওমি মাদ্রাসায় পড়তে দেই। সেখানে দুই বছর পড়ার পরে চলে আসে বাড়িতে। এরই মধ্যে মেয়ের বিয়ে হয় খলিল কবিরাজের সঙ্গে। এরপর তাদের চান্দ্রা বাড়িতে কিছুদিন তাদের সঙ্গে ছিল আমার নাতি। ওই বাড়িতে একা থাকতে সমস্যা হওয়ার কারণে আমার কাছে চলে আসে। এরপর কয়েক বছর আমাদের বাড়িতেই ছিল।

তিনি আরও বলেন, সাহাদাতের বয়স ১৬ হলেও নাতি আমার দেখতে অনেক সুন্দর ও লম্বা হয়েছে। কিছুদিন আগে কাজ নেয় ফরিদগঞ্জ শহরে একটি কাপড়ের দোকানে। সেখানে কাজ করত আর মাঝে আমাদের বাড়িতে এসে থাকত। সর্বশেষ ২ আগস্ট বাড়ি থেকে ফরিদগঞ্জ কাজে চলে যায়। যাওয়ার সময় আমাকে বলে, নানু আমি সোমবার (০৫ আগস্ট) বাড়িতে আসব। কিন্তু নাতি আমার এসেছে লাশ হয়ে। কীভাবে কি হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারিনি।

সাহাদাতের মামা সোহাগ হোসেন ব্যাপারী বলেন, গত ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় ফরিদগঞ্জ থেকে লোকজন ফোন করে জানায় আপনার ভাগনে সাহাদাত মাথায় গুলি খেয়ে গুরুতর আহত হয়েছে। খবর শুনে সন্ধ্যার পরে তার মা শিরতাজসহ চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে চলে যাই। সেখানে তাকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

তিনি আরও বলেন, লোকজনের কাছ থেকে জানতে পেরেছি শেখ হাসিনার পতনের খবর শুনে লোকজন মিছিল নিয়ে নামে। ওই মিছিলে সাহাদাতও ছিল। থানার পাশে মন্দিরের সামনে সাহাদাত পুলিশের গুলিতে আহত হয়। সাহাদাতের লাশ রাতেই বাড়িতে নিয়ে আসি। পরদিন সকালে বাড়ির সামনে জানাজা শেষে দাফন করা হয়।

সাহাদাতের নানা কলিম উল্লাহ ব্যাপারী বলেন, আমার নাতি খুবই দুর্ভাগা। সে ঠিকমতো তার বাবা-মায়ের আদর পায়নি। তাদের রেখে বাবা চলে গেছে অন্যত্র। মায়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আমার নাতির শাসন কিংবা আদর করার একান্ত কেউ ছিল না। আমরা গরিব। কৃষিকাজ করে সংসার চলে। যতটুকু সম্ভব নাতিকে লালন পালনের চেষ্টা করেছি।

তিনি আরও বলেন, সাহাদাত শহিদ হওয়ার পরে এ পর্যন্ত অনেক লোকজনই এসেছে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। এর মধ্যে রাজনৈতিক দল বিএনপির এম এ হান্নান ও লায়ন হারুনর রশীদ কিছু আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। আর ফরিদগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন থেকে আমাদেরকে ১০ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান দিয়েছে। আমার এই ছোট নাতিকে কেন গুলি করে হত্যা করা হলো আমি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এর বিচার চাই।

সাহাদাতের সৎপিতা আমির হোসেন কবিরাজের (৬০) সঙ্গে মোবাইলে কথা হলে জানান, আমার বিয়ের পরে মাঝে মাঝে সে আমাদের কাছে থেকেছে, আমি যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করেছি। আমাদের ফরিদগঞ্জের বাসায় আসতো, আমি নিজেই তাকে ফরিদগঞ্জ বাজারের একটি কাপড়ের দোকানে কাজ নিয়ে দিয়েছি।

সাহাদাতের মা শিরতাজ বেগম (৪০) এর সাথে মোবাইলে কথা হলে তিনি বলেন, আমার ছেলেটা খুব অসহায় ছিল। তার আসল পিতা সাহাদাত আমার পেটে আসার ছয় মাস পর থেকেই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তার জন্য আট বছর অপেক্ষা করে আমি পরে আবার বিয়ে করেছি। কিন্তু আমাকে ছেলেসহ বিয়ে করার জন্য বর্তমান স্বামীর আগের সন্তানরা বাড়িতে উঠতে দেয় না। তাই বিভিন্ন জায়গায় ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি। এখন ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদরের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকি। অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে ছেলেটাকে ঠিকমতো পড়াতেও পারিনি। হেফজখানায় দিয়েছিলাম। কিন্তু সে মনোযোগী না হওয়ায় সেখান থেকে চলে আসতে হয়েছে। মাত্র কাজ শিখতে দোকানে চাকরি নিয়েছিল। এই ছেলেটা ছিল আমার সম্বল। এখন তাকে ছাড়া আমি কী নিয়ে বাঁচব বলেন?

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ছোট ভাইয়ের বিয়েতে বর সেজে গেলেন বড় ভাই, অতঃপর...

সেন্টমার্টিন থেকে ফেরার পথে মাঝ সমুদ্রে জাহাজ বিকল

বিপিএল উত্তাপে আলোচনায় সাকিব

‘অপরাধীদের প্রতি কোনো ক্রমেই নমনীয় হবে না পুলিশ’

অপশক্তির প্ররোচনায় সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড, বাসার নিন্দা ও প্রতিবাদ

এবার সানা বিমানবন্দরে ইসরায়েলের হামলা

‘ভারত বাংলাদেশকে একটি নতাজানু দেশ হিসেবে দেখতে চায়’

চাঁদা না পেয়ে হামলার অভিযোগ বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে

সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও ঘটেনি : চরমোনাইর পীর

সারজিসের বিরুদ্ধে সমন্বয়ক মিতুর শ্লীলতাহানির অভিযোগ দাবিতে ভুয়া ভিডিও

১০

অনূর্ধ্ব-১৯ নারী বিশ্বকাপের জন্য বাংলাদেশের দল ঘোষণা

১১

নাম গোপন রেখে চাকরি নেওয়ার কারণ জানালেন ইরফান

১২

এবার এভারটনকেও হারাতে পারল না সিটি

১৩

‘উসকানি দিয়ে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি করা যাবে না’

১৪

আসন ফাঁকা রেখেই বন্ধ হলো নোবিপ্রবির ভর্তি কার্যক্রম

১৫

জবি শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি বাতিলে তারেক রহমানকে স্মারকলিপি

১৬

কুর্দিদের প্রতি এরদোয়ানের ক্ষোভের মূল কারণ

১৭

কাকরাইল মসজিদে সাদপন্থিদের সব কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ

১৮

যুব মহিলা লীগ নেত্রী সাজেদা গ্রেপ্তার

১৯

ঝিনাইদহে পুকুরে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু

২০
X