এইচএসসি পরীক্ষার্থী রোহানের স্বপ্ন ছিল সেনা কর্মকর্তা হওয়ার। কিন্তু জুলাই মাসের মাঝামাঝি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় তখন ১৯ জুলাই রোহান পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। সে সঙ্গে স্বপ্নও ধূলিসাৎ হয়ে যায় তার।
বাবা-মায়ের স্নেহ, ভালবাসা এবং পারিবারিক বন্ধনকে উপেক্ষা করে রোহানের মতো অনেক কিশোর-কিশোরীই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। ফলে তাদের জোরালো এই প্রতিবাদ একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার যৌথ আন্দোলনে রূপ নেয়। যার মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার ১৬ বছরের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটে।
গত ১৯ জুলাই দুপুর আড়াইটার দিকে কাজলায় আন্দোলনকারীদের মধ্যে পানির বোতল বিতরণ করছিলেন রোহান। এ সময়ে তার বুকে গুলি লাগে। গুরুতর আহত হন তিনি। হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আঠারো বছর বয়সী রোহান শৈশব থেকেই প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং পরোপকারী ছিলেন। তিনি তার সদাচরণ দিয়ে প্রতিবেশী, বন্ধু, শিক্ষক এবং সতীর্থদের মন জয় করেছিলেন। এ কারণেই রোহানের মৃত্যু সংবাদে তার ঢাকার এবং চাঁদপুরের প্রতিবেশীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে।
রোহানের বাবা মো. সুলতান খান যাত্রাবাড়ীর দনিয়ার গোয়ালবাড়ি মোড় এলাকায় তার বাসার পাশে একটি মুদি দোকান চালান।
তিনি বলেন, যখন রোহানের মরদেহ বাসার পাশে বায়তুস সালাম মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সর্বস্তরের মানুষ সেখানে ভিড় জমায় এবং তার প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করে।
রোহানের শোকাতুর বাবা বলেন, আমরা প্রতিবেশীদের শেষ বারের মতো দেখানোর জন্যই রোহানের লাশ মসজিদে নিয়েছিলাম। কিন্তু রোহানের সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব এবং শিক্ষকসহ হাজার হাজার মানুষ তাকে শেষ বারের মতো দেখার জন্য মসজিদে ভিড় করে এবং সেখানে তার প্রথম নামাজ-ই-জানাজায় অংশ নেয়।
মো. রোহান আহমেদ খান ২০২২ সালে এ কে উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে সফলভাবে এসএসসি পাস করার পর দনিয়া কলেজে ভর্তি হন। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সাতটি পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। কিন্তু অসুস্থতার কারণে একটি পরীক্ষায় ভালোভাবে অংশ নিতে পারেননি। ফলে এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন তিনি। তবে যেসব পরীক্ষায় তিনি অংশ নিয়েছিলেন তার ভিত্তিতে দেখা যায়, তিনি বিজ্ঞান বিভাগের তিনটি বিষয়ে জিপিএ ৫ পেয়েছিলেন এবং বাকি তিনটি বিষয়ে জিপিএ-৪ পেয়েছিলেন।
রোহানের মা মনিরা বেগম জানান, রোহান শুরু থেকেই আন্দোলনে অংশ নিতো। কিন্তু তারা বিষয়টি জানতেন না। মনিরা বেগম একজন অনানুষ্ঠানিক আরবি শিক্ষক। তিনি তার এক ছাত্রের মায়ের মাধ্যমে প্রথম রোহানের আন্দোলনে যাওয়ার কথা জানতে পারেন।
তিনি বলেন, প্রথম যেদিন রোহান আন্দোলনে যায় সেদিন সে আমাকে বলেছিল যে সে কলেজের একটি অনুষ্ঠানে যাচ্ছে। কিন্তু ১৬ জুলাই আমি আমার এক ছাত্রের মায়ের কাছে জানতে পারি, রোহানকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতে দেখা গেছে। সে সময় রোহানকে ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণের কথা জিজ্ঞেস করলে প্রথমে সে অস্বীকার করে।
রোহানের মা ছেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্না ধরে রাখার চেষ্টা করেন। তবু অশ্রুসিক্ত কন্ঠে তিনি বলেন, আমি তাকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলে সে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। সে বলে, যখন আমার অনেক ভাই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে তখন তো আমি আর ঘরে বসে থাকতে পারি না।
গত ১৭ জুলাই রোহান আন্দোলনে অংশ নিলে সেদিন তার পায়ে ইটের আঘাত লাগে। এতে তিনি আহত হলে মায়ের কাছে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কথা স্বীকার করেন এবং পায়ের একটা এক্সরে করার কথা বলেন।
রোহানের মা ছেলের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি সেদিন পায়ের এক্সরে করাতে অস্বীকার করে বলি, এক্সরে করে যদি দেখা যায় কিছু হয়নি তাহলে তুমি আবার আন্দোলনে যাবে। সেদিন আমার কথা শুনে রোহান আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে নুডুলস খেতে চেয়েছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সে সময় রোহান তার মাকে আন্দোলনে যাওয়ার গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। রোহানের শোকাহত মা বলেন, একপর্যায়ে আমি তার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করায় সে ১৮ জুলাই আন্দোলনে যাওয়া থেকে বিরত থাকে।
আবু সাঈদ ও মীর মুগ্ধর মৃত্যুতে রোহান অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলো উল্লেখ করে মনিরা বলেন, ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় রোহান আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল আবু সাঈদ আর মুগ্ধ ভাইকে দেখো। তাদের হত্যা করা হয়েছে। আমরা সবাই যদি ঘরে বসে থাকি এবং একে অপরকে আন্দোলনে যোগ দিতে বাধা দিই, তাহলে আমরা কীভাবে স্বাধীনতা অর্জন করব?
তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে রোহান আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি রাজাকার?’ এটা শুনে আমি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি।
তিনি জানান, ১৯ জুলাই শুক্রবার রোহান জুম্মার নামাজের আজানের আগ পর্যন্ত ঘরের কাজ শেষ করতে তাকে সাহায্য করেন। সেদিন দুপুরের খাবারের জন্য কী রান্না হয়েছে তা জানতে চায়। রোহান বিরিয়ানি খেতে ভালোবাসতো উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেদিন আমি তাকে বলেছিলাম, আজ আমাকে অনেক কাজ করতে হবে। তাই, বিরিয়ানি রান্না করিনি, তুমি আজ পাবদা মাছ দিয়ে ভাত খাও।
তিনি কান্না সংবরণ করতে করতে বলেন, আমি আমার ছেলের মৃত্যুর আগে তার প্রিয় খাবার খাওয়াতে পারিনি, এই কষ্ট আমি কি করে ভুলব।
মনিরা জানান, এরপর রোহান জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যায় এবং বাড়ি ফিরে আসে। বাড়িতে আসার পর রোহান তার পাঞ্জাবি খুলে তার কলেজের আইডি কার্ড, মানিব্যাগ, পকেট টিস্যু ও গেটের চাবি নিয়ে দুইটা পাঁচ মিনিটের দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।
কান্না দমন করতে করতে তিনি বলেন, বেলা প্রায় আড়াইটার দিকে, একজন অচেনা লোক আমাকে ফোনে জানায় যে, রোহান গুরুতর আহত এবং আমাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে যেতে বলে।
খবরটি পাওয়ার পর তিনি হতবিহ্বল হয়ে পড়েন এবং কোনোমতে তার স্বামীকে বিষয়টি জানান।
আন্দোলনে রোহানের একাগ্রতার কথা স্মরণ করে তার মা বলেন, রোহান বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) প্রায় সারারাত ‘আমি হব আন্দোলনের চাবি, তোমরা করবে সিংহাসনের দাবি’ এই স্লোগানটি আবৃত্তি করেছিল।
রোহানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার টেবিলে স্কাউটের ইউনিফর্মসহ একটি ছবি এবং বাংলাদেশ স্কাউটসের সম্মাননা স্মারকসহ তার সব বই এবং জিনিসপত্র একইভাবে রাখা আছে। তার টেবিলেই একটি কোরআন শরিফ রাখা, যা তিনি পাঠ করতেন। কোরআন শরিফে রোহানের দেওয়া চিহ্নটি দেখিয়ে তার মা বলেন, এখন আমি এই কোরআন তেলাওয়াত করি, কিন্তু আমি আমার ছেলের দেওয়া চিহ্ন সরাইনি। এটা আমার ছেলের স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি।
জানা যায়, রোহানের বাবা ও বড় ভাই হাসপাতাল থেকে মরদেহ গ্রহণ করে ২০ জুলাই চাঁদপুর সদর উপজেলায় তাদের গ্রামের কবরস্থানে আরও দুটি নামাজে জানাজা শেষে তাকে দাফন করেন।
রোহানের বাবা মো. সুলতান জানান, তার দুই সন্তানের মধ্যে রোহান ছোট। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের ব্যাপারে রোহান অত্যন্ত আশাবাদী ছিলেন।
তিনি অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, সেনাবাহিনীতে যোগদানের ইচ্ছা থেকেই রোহান বাংলাদেশ স্কাউটসে যোগ দিয়েছিল। তার বিশ্বাস ছিল, স্কাউটসের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা তাকে একজন সেনা কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ পেতে সাহায্য করবে।
সুলতান ভারি গলায় বলেন, রোহানকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। সে আমাকে আমার মুদির দোকান চালাতে সাহায্য করত। পড়াশোনার পাশাপাশি সে তার মাকে ঘরের কাজেও সাহায্য করত।
রোহানের ভ্রমণের শখ ছিল। বিশেষ করে তিনি ভারত ও অস্ট্রেলিয়া সফরের পরিকল্পনার কথা বলতেন।
সুলতান বলেন, সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনের আশায় আমার দুই ছেলেকে পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু আমার ছোট ছেলেকে হারিয়ে এখন আমার বড় ছেলেকে বিদেশে পাঠানো আমার পক্ষে অসম্ভব।
রোহানের বড় ভাই রাহাত আহমেদ খান নগরীর আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে তৃতীয় বর্ষে (সম্মান) অধ্যয়নরত।
তিনি বলেন, এখন সরকার আমার বড় ছেলে মো. রাহাত আহমেদ খানকে একটি ভালো চাকরি দিলে তাতে আমার সংসার চালাতে সুবিধা হবে।
ছেলের অকাল প্রয়াণে শোক প্রকাশ করে রোহানের কান্নারত বাবা বলেন, আমার ছেলেকে হারিয়ে আমাদের পরিবারের সবকিছু থমকে গেছে। আমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।
রোহানের বড় ভাই রাহাত ছোট ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, আমি রোহানকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারি না। সারাক্ষণ ওর কথা মনে পড়ে।
রোহানের কর্মচঞ্চলতার কথা স্মরণ করে রাহাত বলেন, রোহান সবসময় মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করত। কারণ সে বিশ্বাস করত যে বাংলাদেশ স্কাউটস-এর সদস্য হিসেবে এটা তার কর্তব্য। কখনও কখনও রোহান অনেক সময় রাতে বাড়ির বাইরে চলে যেত। হয়তো কোনো গুরুতর রোগীর জন্য রক্ত প্রয়োজন, তখন সে নিজে অথবা অন্য কারো মাধ্যমে তাদের রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করত। গভীর রাতে বাড়ি ফেরার বিষয়ে জানতে চাইলে বলত, ‘একটু চিন্তা করে দেখো, গভীর রাতে যদি তুমি কোনো বিপদে পড়ো বা তোমার জন্য রক্তের প্রয়োজন হয়, তখন কি আমরা ঘরে বসে থাকতে পারব?’
রোহানের মৃত্যুর পর বাংলাদেশ স্কাউটসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন উল্লেখ করে রাহাত বলেন, বাংলাদেশ স্কাউটস শহীদ রোহানকে সম্মাননা স্মারক দিয়েছে।
বাংলাদেশ স্কাউটসের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, রোহানসহ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ স্কাউটস সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ওয়েবসাইটে একটি ব্যানার ছবি প্রদর্শন হচ্ছে।
রাহাত বলেন, বাংলাদেশ স্কাউটসের চেতনা যে কোনো সংকট বা দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। রোহান স্কাউটসের এই চেতনা নিয়েই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলো।
বাংলাদেশ স্কাউটসের সদস্য মুগ্ধকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে রোহানও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে পানি ও বিস্কুট বিতরণ করছিলেন। শহীদ হওয়ার দিন তিনি আন্দোলনকারীদের জন্য পানি কিনতে ৩০০ টাকা চেয়েছিলেন।
রাহাত বলেন, রোহানের অকালমৃত্যুতে আমরা দিশেহারা। আমরা জানি না আমাদের সময় কীভাবে বয়ে যায়। আমরা আন্দোলনে শহীদ রোহানসহ সকাল হত্যার বিচার চাই।
মন্তব্য করুন