সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে ২৮৫ জন প্রতিবন্ধী প্রার্থীকে ২০১৩ সালের বিধিমালায় প্রতিবন্ধী কোটায় ১৪ জানুয়ারি নিয়োগের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। রায়ে আদালত বলেছেন, রায়ের অনুলিপি গ্রহণের ৯০ দিনের মধ্যে নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু এই রায়ের প্রেক্ষিতে চলতি বছরের গত অক্টোবরে আপিল করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পরীক্ষা-২০১৮ এবং ২০২০-এর প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী প্রতিবন্ধী কোটায় নিয়োগের জন্য তারা আবেদন করেন। ২০২২ সালে লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হন এবং মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন। কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশিত হলে দেখা যায়, সেখানে কোনো প্রতিবন্ধী প্রার্থীকে সুযোগ প্রদান করা হয়নি। অথচ সংস্থাপন মন্ত্রণালয় (বর্তমান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়) কর্তৃক জারিকৃত ১৭ /০৩ / ১৯৯৭ তারিখের পরিপত্র অনুযায়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির সহকারী শিক্ষক পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের দ্বারা পূরণ করার বিধান রয়েছে।
সূত্রে আরও জানা যায়, ২০২২ সালে প্রকাশিত নিয়োগ পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ হয়। ওই ফলাফলে ৩৭ হাজার ৫৭৪ জনকে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ দিলেও প্রতিবন্ধী কোটায় কোনো প্রতিবন্ধী প্রার্থীকে সুযোগ দেওয়া হয়নি উল্লেখ করে চারটি রিট করেন তারা। ২০২২ সালে একটি এবং ২০২৩ সালে তিনটি। পৃথক পৃথকভাবে প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট রুল দেন। পরে চারটি রিটের ওপর একসঙ্গে শুনানি শেষে হাইকোর্ট রুল চূড়ান্ত (অ্যাবসলিউট) রায় দেন। রুলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পরীক্ষা ২০২০-এর প্রকাশিত চূড়ান্ত ফলাফলে ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা পূরণ করে রিটকারী প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ না দেওয়া কেন অবৈধ হবে না এবং ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা পূরণ করে রিটকারী প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগের নির্দেশনা কেন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়েছেন। চার সপ্তাহের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জবাব দিতে বলা হয়।
সহকারী শিক্ষক পদে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও শারীরিক প্রতিবন্ধী আজিজুল হাকিম, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাজ্জাদ হোসেন সাজু, কামাল হোসেন পিয়াস, কৌশিক আহমেদ সজিব, নূরে আলম, সাখাওয়াত হোসেনসহ ২৮৫ চাকরিপ্রত্যাশী প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
আজিজুল হাকিমের জন্ম পাবনার বেড়া উপজেলায়। বয়স ২৭ এর কাছাকাছি। ৫ বছর বয়সে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ডান হাত হারায়। বাম হাত কবজি থেকে অকেজো হয়ে যায়। তবে বাম হাতে লেখালেখি করেন। মানবিক বিভাগে ২০১৩ সালে এসএসসিতে জিপিএ ৪.৮১, ২০১৫ সালে এইচএসসিতে ৫, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক ৩.৩৩ এবং স্নাতকোত্তরে ৩.৪৭ পান।
আজিজুল হাকিম বলেন, পাবনার বেড়া উপজেলায় ৭৮ জন সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলেও কোনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এতো কষ্ট করে লেখাপড়া শিখে সেই কাঙ্ক্ষিত চাকরি যদি আমরা না পাই, তাহলে তো আমাদের লেখাপড়া ব্যর্থ হয়ে গেল।
কামাল হোসেন পিয়াস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর করেছেন। তিনিও এই বৈষম্যের শিকার। কামাল হোসেন পিয়াস বলেন, ২০১৯ সালের বিধিমালায় প্রতিবন্ধী কোটা বিলুপ্ত করা হয়। কিন্তু ২০১৩ সালের বিধিমালা অনুযায়ী আমরা যারা লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি তাদের তৃতীয় শ্রেণির কোটায় নিয়োগ হওয়ার কথা। সেই অনুযায়ী এতিম /প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ১০ শতাংশ কোটা বাতিল হওয়ার কথা নয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সার্কুলেশন নন গেজেটেড। জনপ্রশাসন তা উল্লেখ না করায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা না রেখেই সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ দিয়েছে।
তিনি বলেন, তথ্য অধিকার আইনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে আমরা জানতে চাইলে বিষয়টি জানায়। এরপরই আমরা মামলা করি। হাইকোর্ট আমাদের পক্ষে মামলার রায়ও দিয়েছে।
আরেক চাকরিপ্রত্যাশী সাজ্জাদ হোসেন সাজু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর করেছেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, আমাদের একটাই দাবি, তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত যে রায় দিয়েছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাকরিতে নিয়োগের পক্ষে, এটা যেন দ্রুত বাস্তবায়ন করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেছে, এটা তাদের ধারাবাহিক নিয়ম। আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। আপিল করায় দিনের পর দিন যেন আমাদের আদালতের দ্বারে ঘুরতে না হয়। রায়ের কপি আদালত থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠালেও আমরা কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং প্রধান উপদেষ্টাকে দু’বার রায়ের কপিসহ স্মারকলিপি দিয়েছি।
রিটের পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালেয়ে নিয়োগসংক্রান্ত, সার্কুলার সংক্রান্ত, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কোনো কাজ নেই। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আইনগতভাবে ২৮৫ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ দিতে বাধ্য। তারা যদি না বুঝে এই কাজটি করে থাকেন তাহলে ঠিক আছে। যদি বুঝে এই কাজটি করেন, তাহলে তা আদালত অবমাননার সামিল। একজন নাগরিকের চাকরির অধিকার ক্ষুণ্ণ করেছেন। আপিল করলেও পূর্বের সার্কুলারের আলোকে নিয়োগ দিতে হবে। কারণ কোটা সেখানে ছিল। তারা আইনগত এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে বাধ্য। যেখানে আদালতের রায় রয়েছে। সেখানে এই নিয়োগ প্রার্থী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের তারা বঞ্চিত করছে।
তিনি বলেন, এর ফলে প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন, সাংবিধানিক অধিকার তাদের রয়েছে তা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। আমি আশা করব তারা দ্রুত নিয়োগ কার্যকর করবেন। এই নিয়োগ যখন হয়েছিল, তখন কোটা ছিল। এই নিয়োগের কাযক্রম কোটার আলোকে হবে। এই রায়ের আলোকে কোটা থেকে তারা ২৮৫ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিয়োগ বঞ্চিত করতে পারবেন না। এখনকার নিয়োগ সার্কুলারে শুধু কোটা বাদ যাবে। পূর্বেরটায় নয়। তারা হাইর্কোটের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে চাকরিতে নিয়োগ দিবে বলে আশা করি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বিধি-১) মোহাম্মদ শামীম সোহেল কালবেলাকে বলেন, আমাদের কাছে কেউ মতামত চাইলে আমরা মতামত দেই। মন্ত্রণালয় আমাদের কাছে তথ্য -উপাত্তসহ জানতে চাইলে মতামত দেই। তবে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য আমার জানা নেই।
বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সুরক্ষা আইন ২০১৩ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষায় বাস্তবায়ন করে। এই আইনে বলা আছে, প্রতিবন্ধিতার কারণে কেউ কোনো বৈষম্যের শিকার হতে পারবে না। কারো সঙ্গে বৈষম্য করা যাবে না। তার যোগ্যতা থাকলে প্রতিবন্ধিতা থাকা সত্ত্বেও কোটা অনুসারে ওই পর্যায়ে পৌঁছাতে সক্ষম হবে। কেউ কোনো বাধা দিতে পারবে না।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ এ ব্যাপারে কালবেলাকে বলেন, সহকারী শিক্ষক পদে ২৮৫ চাকরিপ্রত্যাশী প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিয়োগের বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গত অক্টোবর মাসে আপিল করা হয়েছে। হাইকোর্ট এই আদেশের পক্ষে স্টে দিয়েছে। এখন শুনানি পর্যায়ে রয়েছে। আগামী সপ্তাহে এর শুনানি হবে। এটা নিষ্পত্তি হলে আমরা ব্যবস্থা নেব।
বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, সহকারী শিক্ষক পদে চাকরিপ্রত্যাশী ২৮৫ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সব নিয়ম মেনেই যেহেতু পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন, পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, তাই ৯০ দিনের মধ্যেই হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়ন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, শারীরিক কিংবা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অর্থিকভাবে সচ্ছল নয়। তারা অনেক কষ্ট শিকার করে এই পর্যন্ত এসেছেন। তাদের পক্ষে সব যুক্তি ও হাইকোর্টের রায় আছে, তাই রায় না মানা মানবাধিকার লঙ্ঘন। হাইকোর্ট যেহেতু তাদের নিয়োগের পক্ষে রায় দিয়েছে, তাদের প্রাপ্য তাদের দেওয়া হয়নি, এই ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে তা পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
মন্তব্য করুন