কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২০ পিএম
আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

বিপ্লবের মাধ্যমে ছাত্র-শিক্ষক মুক্তবুদ্ধির চর্চা ফিরে পেয়েছে : প্রধান উপদেষ্টা

আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তব্য দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি : কালবেলা
আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তব্য দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি : কালবেলা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আজ বিপ্লবের মাধ্যমে ছাত্র-শিক্ষক সমাজ তাদের চিন্তার স্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে আবার ফিরে পেয়েছেন। এর সঙ্গে এখন বিশ্ব-বিজ্ঞানে অবদান রাখার সক্ষমতাকেও যোগ করতে হবে। আকাঙ্ক্ষাকে উচ্চে রেখে দৈনন্দিন পঠন-পাঠন গবেষণার মাধ্যমেই সেটি অর্জিত হয়।

বৃহস্পতিবার (০৭ নভেম্বর) মিন্টো রোডস্থ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কনভেনশন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ এবং বোস সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডি অ্যান্ড রিসার্চ ইন ন্যাচারাল সাইন্সেসের যৌথ উদ্যোগে ৪ দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনকালে তিনি এসব কথা বলেন।

এ ছাড়াও উদ্বোধনী পর্ব শেষে আগামী ৮ থেকে ১০ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে সম্মেলনের সায়েন্টিফিক সেশন অনুষ্ঠিত হবে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজ আমরা আমাদের দেশের এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের একজন উজ্জ্বলতম তারকার মহত্তম অবদানটির শতবার্ষিকী উদযাপন করতে এসেছি। তিনি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, যিনি ১৯২৪ সালের এমনি একটি সময়ে তার আবিষ্কার বোস-আইনস্টাইন কোয়ান্টাম স্ট্যাটিসটিক্সের জন্য বিজ্ঞান ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। আর তিনি এটি করেছিলেন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নবীন অধ্যাপক হিসেবে কার্জন হলের একটি কামরায় বসে। আজো যেটি পদার্থবিদ্যার ছাত্র-শিক্ষকদের প্রাণচাঞ্চল্যে মুখরিত। আবিষ্কারের গুরুত্বের কারণে পৃথিবীর নানা দেশের পদার্থবিদরা এই শতবার্ষিকী উদযাপন করছেন। কিন্তু আমাদের জন্য এই আবিষ্কারের মর্মটাই আলাদা। পদার্থবিদরা বলেন বিংশ শতাব্দীর ওই পর্যায়ে পদার্থবিদ্যায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছিলো কোয়ান্টাম থিওরির মাধ্যমে। এটি ছিল তার মধ্যে একটি বড় সংযোজন। এর মাধ্যমে বসু বিশ্ববিজ্ঞানের মানচিত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, আমাদের ঢাকা নগরীকে উজ্জ্বলভাবে চিহ্নিত করে দিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, আজ আমরা যখন ছাত্র-জনতার একটি সর্বাত্মক বিপ্লবের মাধ্যমে দেশকে নতুনভাবে গড়ার প্রয়াস নিয়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়কে তার যথাযথ চর্চার জায়গায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছি, তখন পরিবর্তনের দিকদর্শিকা হিসেবে উদযাপনের জন্য বসুর আবিষ্কারের এই শতবার্ষিকীর থেকে যথাযথ বিষয় আর কী হতে পারে? আমাদের বিপ্লবের নায়ক ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রেরণা হিসেবে এর থেকে বড় গৌরবের স্মরণ আর কী হতে পারে? এ উপলক্ষে আয়োজিত আপনাদের এই বিজ্ঞান সভায় আমাকে দুটি কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ করায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। যে সব খ্যাতনামা বিজ্ঞানী বোস-আইনস্টাইন তত্ত্বের অগ্রগতির ওপর বিশ্বময় কাজ করছেন তাদের কয়েকজন আমাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে এবং সত্যেন্দ্র নাথ বসুর আবিষ্কার-স্থানটির প্রতি তাদের আগ্রহের পরিচয় দিয়ে এই সম্মেলনে শরিক হওয়া সবাইকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

আমাদের মনে রাখতে হবে, এসময় এ আবিষ্কারের উদযাপন দুনিয়ার অন্যত্রও ঘটছে, তারা আমাদের সম্মেলনে এসেছেন। বসুর কীর্তির ঢাকা শহরে, বিপ্লবের পুনর্জাগরণের ঢাকা শহরে, তাদেরকে স্বাগতম। ১৯২৪ সাল অনেক পেছনে রেখে এসেছি। কালের পরিক্রমায় বসুর আবিষ্কারটি কি এতটুকু ম্লান হয়েছে? পদার্থবিদরা বলছেন মোটেই না। যার প্রমাণ এই আবিষ্কারের ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্য প্রমাণ করে সৃষ্ট বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছে ২০০১ সালে। এ নিয়ে গবেষণা চলছেই। সারা দুনিয়ার পদার্থবিদ্যার ছাত্ররা জানে যাবতীয় পদার্থ-শক্তি সব কিছুর একেবারে মূলে যে মৌলিক কণিকাগুলো এদের শ্রেণি বিভাজনে একটি বড় ভূমিকা রেখেছে বসুর থিওরির দ্বারা ঠিক করে দেয়া নির্দেশিকা। মহাবিশ্বের সকল মৌলিক কণিকাগুলোকে এভাবে দু‘ভাগ করা যায়- যার এক ভাগের সবগুলোকে বলা হয় বোসন। আমাদের বসুর নামে। এ শব্দটিকে তাদের বারবার মুখে নিতে হয়। এই তো সেদিন ২০১২ সালে জেনেভার বিশাল যন্ত্রে বহুদেশের বিজ্ঞানীরা একযোগে গবেষণা করে খুঁজে পেলেন বহু দিনের অধরা কণিকা হিগ্স বোসনকে, যা সারা দুনিয়ায় হৈচৈ ফেলে দিলো, সে কথা আমাদের দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও হেডলাইন হয়েছিলো।

প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ভাবতে অবাক লাগে তার মাত্র তিন বছর আগে স্থাপিত তখনকার নতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ও বিনীত পরিবেশে সম্ভব হয়েছিল এত বড় আবিষ্কার। শুনেছি কার্জন হলে পঠন-পাঠনের কাজের ভেতরেই নবীন অধ্যাপক বসুর কাছে নতুন কোয়ান্টাম থিওরির শুরুর মধ্যে যে অসঙ্গতি ধরা পড়েছিলো তার থেকেই ওই আবিষ্কারের চিন্তাটি তার মাথায় এসেছিলো। অখ্যাত জায়গার অখ্যাত এই বিজ্ঞানীর এই অদ্ভুত আবিষ্কারের কথা দুনিয়ার কোন জার্নাল ছাপতে যাবে? কিন্তু নিজের কাজের ওপর অত্যন্ত আস্থাশীল বসু সোজা সেদিনের দুনিয়ায় সব থেকে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কাছে জার্মানীতে পাঠিয়ে দিলেন এ আবিষ্কার নিয়ে তার ছোট্ট প্রবন্ধটি। সঙ্গে চিঠি দিলেন, নিজের পরিচয় দিলেন ‘আমি আপনার সরাসরি ছাত্র না হলেও ‘আপনার ভাব-শিষ্য' এই বলে। আইনস্টাইন চট্ করে বুঝে ফেললেন, এ কোন সাধারণ আবিষ্কার নয়। এর সঙ্গে নিজেরও একটি বাড়তি ধারণা যোগ করে এবং প্রবন্ধটি নিজের হাতে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে পদার্থবিদ্যার বিখ্যাত জার্নালে পাঠিয়ে দিলেন। সেই থেকে এটি বোস-আইনস্টাইন থিওরি।

বিশ্ববিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত বসু কিন্তু ঢাকা থেকে হারিয়ে গেলেননা। বাকি সময় এখানে কাটালেন গবেষণায় ও নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগের কাণ্ডারী হিসেবে বিভাগের উন্নয়নে। আনলেন বহু সুযোগ্য সহকর্মী, তাত্ত্বিক মানুষ হয়েও নিজের হাতে ল্যাবোরেটরি গড়ার কাজে মন দিলেন। অনেক যন্ত্র নিজেই তৈরি করেছেন- শুনেছি তার কিছুর ভগ্নাংশ এখনো কার্জন হলে আছে। আর তিনি রইলেন আমাদের ঢাকা শহরের হয়ে- সেদিনের ছোট্ট সাদামাটা ঢাকা শহরের। এখানে তিনি শুধু কঠিন তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী ছিলেন না, ছিলেন শহরের সংস্কৃতিবান গণ্যমান্য নাগরিক, যিনি তার এস্রাজ বাজনার জন্যও কদর পেতেন। শিক্ষার সর্বস্তরে, বিশেষ করে উচ্চতর বিজ্ঞান শিক্ষায় বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য তর্ক বিতর্ক করছেন, বাংলায় বই লিখছেন, পত্রিকা বের করছেন, নিজের পাঠদানে বাংলা ব্যবহার করছেন। শহরের সাহিত্যানুরাগী সংস্কৃতিসেবীদের কয়েকজনকে নিয়ে নিয়মিত বৈঠকি আড্ডা গড়ে তুলেছেন। সেদিনের বৃক্ষশোভিত সবুজ রমনায় যে বহু লাল ইটের টালির ছাদের বাড়ি ছিল, সবাই চিনতো কার্জন হলের পাশে তারই একটা বোস সাহেবের। কেন জানি ঢাকার সাধারণ মানুষ তাকে বোস সাহেব বলেই ডাকতো। মাঝে মাঝে একটি ঘোড়ার গাড়ি এসে থামতো, তখন ওটিই ঢাকার প্রধান যানবাহন; সপরিবারে বোস সাহেব যেতেন নওয়াপুরে মুকুল থিয়েটারে নাটক দেখতে।

তিনি বলেন, পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখনকার ঢাকার সঙ্গে বসুর ঢাকারই মিল বেশি ছিল, আজকের ঢাকার থেকে। কাজেই পরিবেশটি বেশ কল্পনা করতে পারি, ঢাকার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেই শান্ত ছোট শহরকে, সেই সবুজ রমনাকে আর ফেরত আনা যাবে না, কিন্তু সেই গৌরবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা অবশ্যই ফেরৎ আনতে পারি, আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে।

বিপ্লবের ফসল আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার এর জন্য প্রয়োজনীয় সব সংস্কার করতে এবং এর উপর্যুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির সকল প্রয়াস নিতে প্রস্তুত রয়েছে। এই কাজে নিবেদিত সবার কাছ থেকে চাহিদা, পরামর্শ আসতে হবে। নিজের ওপর আস্থা থাকলে এটি আমরা পারব। যেমন আস্থা বসুর ছিল বলে তিনি সম্পূর্ণ অপরিচিত হয়েও আইনস্টাইনকে লিখতে পেরেছিলেন। সব সময় আমাদেরকে আমাদের মধ্যে এদের মনে আস্থার বিশ্বাস সৃষ্টি করতে করতে আমরাই যেন বিশ্বের কাছে যেতে না হয়, বিশ্ব যেন আমাদের কাছেও আসে। আমাদের তরুণদের মনে বিশ্বাস সৃষ্টি করতে হবে যে, আমরাই বিশ্ব। আজ আমরা সেই আকাঙ্ক্ষারই শতবার্ষিকী পালন করছি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশে নজর জিনপিংয়ের

‘উন্নয়নের নামে লুটপাট করেছে আ.লীগ সরকার’

২৩ নভেম্বর: ইতিহাসের আজকের এই দিনে

ঢাকার যেসব এলাকায় আজ মার্কেট বন্ধ

আজকের নামাজের সময়সূচি

প্রথম দিনে উইন্ডিজ তুলল ২৫০ রান

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

১০

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

১১

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

১২

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

১৩

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

১৪

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

১৫

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

১৬

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

১৭

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১৮

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১৯

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

২০
X