পেশায় লেগুনা চালক শহীদ মো. আসাদুল্লাহ বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন। কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের যে আন্দোলন চলছিল তা এড়াতে পারেননি তিনি। গত ১৮ জুলাই শামিল হয়েছিলেন মিছিলে। অনেক কষ্টে ধার-দেনা করে তার সদ্য কেনা লেগুনাটিকে উত্তরার আজমপুর রেল ক্রসিংয়ের পাশে রেখে চলে গিয়েছিলেন প্রায় এক কিমি দূরের আজমপুর বাসস্ট্যান্ডে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূল স্পটে। ছাত্রদের ওপর তখন চলছিল মুহুর্মুহু গুলি। এতে আহত হয়েছে শত শত এবং নিহত অনেক। শেষ পর্যন্ত নিহতের তালিকায় যুক্ত হলেন আসাদুল্লাহও। সন্ধ্যা ৬টার সময় পুলিশের বুলেটে ঘটনাস্থলেই শাহাদাত বরণ করেন তিনি।
দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেই চলছিল পরিবারটির। আসাদুল্লাহর (২৪) শ্বশুর লষ্কর আলী সামান্য সবজি বিক্রেতা। সেই শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে একটি রুম নিয়ে উত্তরার উত্তরখান থানার হেলাল মার্কেট সরকারবাড়িতে কোনোমতে থাকতেন তিনি। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ঘরে রেখে গিয়েছিলেন। স্ত্রী এবং শ্বশুর প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা নিয়ে বারবার তাকে ফোন দিচ্ছিলেন আর তিনি তাদের অভয় দিচ্ছিলেন, লেগুনা গাড়িটি নিয়ে তিনি বের হতে পারছেন না। মানুষের ভিড়ের মধ্যে পড়ে গেছেন অথচ তার পরিবার এখন পর্যন্ত জানে না, তিনি লেগুনা রক্ষা না বরং লেগুনাকে এক জায়গায় রেখে দেশকে রক্ষা করতে চলে গিয়েছিলেন এক কিলোমিটার দূরের আন্দোলনে। যোগ দিয়েছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে।
শহীদ মো. আসাদুল্লাহ। ছবি : সংগৃহীত
এর মধ্যে কিশোরী মা নূরানী খাতুনের কোলজুড়ে আয়েশা পৃথিবীতে এসেছে। এখন তার পুরো জীবন সামনে পড়ে আছে। তিনি বলেন, স্বামী নেই, বাবা-মায়ের কাছে আছি। আর শ্বশুর-শাশুড়ি গ্রামে, তারাও খুব খারাপ অবস্থায় দিন আনে দিন খায় এরকম। এখন তার প্রশ্ন, এই দুধের সন্তানকে নিয়ে তিনি কোথায় যাবেন? কার কাছে যাবেন? একা একা এ সন্তানটিকে তিনি কীভাবে মানুষ করবেন?
মোহাম্মদ জৈনদ্দিন ও মোছা. রাশেদা বেগম দম্পতির একমাত্র সন্তান শহিদ মো. আসাদুল্লাহর স্থায়ী ঠিকানা শেরপুর জেলার শ্রীবরদী থানার রহমতপুর গ্রামে। বিয়ে করেছিলেন কাছের মাটিয়া কুড়া গাবতলী গ্রামের মেয়ে নূরানী খাতুন (১৬) কে, যাদের বিয়ের এক বছরও পূর্ণ হয়নি এখনো। এর আগেই তিনি কিশোরী বধূকে বিধবা করে চলে গেলেন অনন্তের উদ্দেশে।
নিজে গাড়ি চালিয়ে মহাজনকে টাকা দিয়ে বেশি কিছু থাকতো না হাতে। তাই টানাটানি লেগেই থাকত। শ্বশুরকে বলেছিলেন, যদি কষ্ট করে একটি গাড়ি নিজেরা কিনতে পারতাম তাহলে একটু সচ্ছলতা আসতো। সেই চিন্তা থেকে নিজের সঞ্চয় আর ধার দেনা করে এক লক্ষ ৬০ হাজার টাকা দিয়ে মাসখানেক আগে একটি পুরাতন লেগুনা কিনেছিলেন। আরও বিশ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল সেটা ঠিকঠাক করতে।
শহীদের স্ত্রী নূরানী খাতুন বলেন, এখন এই লেগুনা আমাদের গলার কাঁটা হয়ে গেছে। পুরোনো লেগুনা কেউ কিনতে চাচ্ছে না। আর এভাবে ফেলে রাখলে গাড়িটাও নষ্ট হয়ে যাবে। এদিকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা এখনো পরিশোধ করা বাকি আছে। কেউ যদি গাড়িটা বিক্রির ব্যবস্থা করে দিত তাহলে ধারগুলো অন্তত শোধ করতে পারতাম।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে প্রতি শহীদের জন্য যে দুই লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, সেই টাকাটা তারা পেয়েছেন। ধার-দেনা পরিশোধ, হাসপাতাল বিল, লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে কাফন-দাফনে তার বিরাট একটা অংশ ইতোমধ্যেই খরচ হয়ে গেছে। বাকি অল্প কিছু টাকা দিয়ে এখন তিনি পুরো জীবন-যুদ্ধ কিভাবে পাড়ি দেবেন সেই দুশ্চিন্তায় হাহাকার করে উঠলেন।
কথা হয় আসাদুল্লাহর শ্বশুড় লস্কর আলীর সঙ্গে। দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে শহীদের স্ত্রী তার বড় সন্তান। তিনি স্বল্প পুঁজির সবজি বিক্রেতা। তিনি বলেন, সেদিন যে কী কিয়ামত গেছে আমাদের ওপর, তা কেবল আমরাই জানি। সন্ধ্যা ৬টায় আমাকে ওই ঘটনাস্থলের কেউ একজন ওর ফোন দিয়ে বলল, আপনারা তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আসেন। এই ফোন যার, সে তো মারা গেছে। আমরা সেই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে রাস্তাই পার হতে পারছিলাম না। মুহুর্মুহু গুলি চলছিল। কোনোমতে অনেক দূর ঘুরে আমরা হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম বাবা আমার মারা গেছে। আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে।
তিনি বললেন, আমি যদি কিছু পুঁজি পেতাম তাহলে সবজিটা ভালো মতো বিক্রি করতে পারতাম। কিংবা নিজস্ব একটা ভ্যান যদি আমার হতো। আমি যতদিন বেঁচে আছি, আমার এই বিধবা মেয়েটাকে আমি নিজেই দেখবো। আমি শুধু শহীদের সন্তানটিকে দেখার জন্য সবার কাছে সহযোগিতা চাচ্ছি। চিরদিন তো আমি বেঁচে থাকব না, আমি চলে যাওয়ার পরে যেন এই বাচ্চাটাকে ওর মা মানুষের মতো মানুষ করতে পারে।
সেদিন এরকম অসংখ্য ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বাসসের এ প্রতিবেদকসহ অন্য সাংবাদিকরা। তারা ঘটনাস্থলেই সারাদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। উত্তরার লাখো মানুষ দেখেছে, কী ভয়ংকর এক যুদ্ধক্ষেত্র। পুরো বাংলাদেশের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার উত্তরার মানুষও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে জ্বলে উঠেছিলেন। আর বিশেষ করে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির ছোঁড়া গুলির তীব্রতায় প্রায় সব মানুষ তার সন্তানরূপী শিক্ষার্থীদের বাঁচানোর জন্য তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। দেশের অন্যতম নিরিবিলি আবাসিক এলাকা হিসেবে খ্যাত উত্তরার মানুষ বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে এরকম ভয়ংকর দৃশ্য এর আগে কখনো দেখেনি।
এ প্রসঙ্গে ঐদিন রণাঙ্গণে উপস্থিত উত্তরা প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক বদরুল আলম মজুমদার বলেন, এত চেষ্টার পরেও কিন্তু আমরা পারিনি আমাদের ছোট ছোট মাসুম বাচ্চাগুলোকে তৎকালীন ফ্যাসিবাদের বাহিনীগুলোর হাত থেকে বাঁচাতে। শুধুমাত্র ১৮ তারিখ সরকারি হিসেবে সারাদেশে নিহতের সংখ্যা ছিল ২৬ জন। কিন্তু আমাদের কাছে ভিডিওসহ প্রমাণ আছে, ওই দিন শুধু উত্তরাতেই শহিদ হয়েছেন ৩০ জনের বেশি। এর বেশিরভাগ লাশ সরকারের পেটোয়া বাহিনী গুম করেছে।
আন্দোলনে সবচেয়ে ভয়ংকর অবস্থায় ছিলাম আমরা সাংবাদিকরা। আমাদের জন্য অনেক লাশ তারা গুম করতে পারেনি। এ কারণে নিরাপত্তা বাহিনী আমাদের দেখলেই আগে গুলি করেছে।
বাসসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উত্তরখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জিয়াউর রহমান ও উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার রওনক জাহান এর সঙ্গে কথা হয়। কিন্তু তারা তেমন কোনো তথ্য জানাতে পারেননি।
থানাগুলোর পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো শহীদের বাড়িতে যাওয়া হয়নি। আমরা থানার কাছ থেকে তালিকা নিয়ে প্রতিটা শহীদের বাড়িতে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। এখন পর্যন্ত আমরা দেখেছি সব শহীদের তালিকা পুলিশের কাছেও নেই।
স্থানীয় প্রশাসনের সদস্যদের অন্ততঃ খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য শহীদদের বাড়িতে যাওয়া তো দূরের কথা স্থানীয় কমিশনার ও জনপ্রতিনিধিরা পলাতক রয়েছেন। তাহলে এত এত শহীদ ও আহত, তাদেরকে কে দেখাশোনা করবে? কে আহতদের চিকিৎসার খরচ বহন করবে? এ প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের।
মন্তব্য করুন