উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ নারীই শক্তি উল্লেখ করে বলেন, সমাজের তৃণমূলে বঞ্চিত নারীরা যারা কাজ করছেন তাদের কৃষি সেবা ও ব্যাংকঋণ প্রাপ্তিতে সরকার নতুন করে পরিকল্পনা নিচ্ছেন। পাশাপাশি প্রান্তিক নারীদের মাঝে ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থাপনার কথাও ভাবছি। এসব বিষয়ে একটি অ্যাপস তৈরি করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বুধবার (৩০ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীয় সিরডাপ মিলনায়তনে তিনি একথা বলেন।অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এএলআরডি) উদ্যোগে ‘সরকারি কৃষিসেবা ও ব্যাংকঋণ প্রাপ্তিতে গ্রামীণ নারী কৃষকের অন্তর্ভুক্তি ও বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা’ শীর্ষক এক সেমিনারে উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন।
প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মেঘনা গুহঠাকুরতা, এফএসআরডি, বিএলআরআই প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান ড. রেজিয়া খাতুন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রঞ্জন সাহা পার্থ এবং এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এএলআরডি উপনির্বাহী পরিচালক ও কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর রওশন জাহান মনি, স্ট্যান্ড ফর হার ল্যান্ড ক্যাম্পেইন, বাংলাদেশ এবং এএলআরডি-র চেয়ারপারসন খুশী কবির সভাপতিত্ব করেন।
উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, আমাদের প্রথম কাজের অগ্রাধিকার হলো দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা মুক্ত করা। তিনি আরও বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় যেসব ভাতাসমূহ রয়েছে তা সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। কারণ এর মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি বিদ্যমান। তাই পিকেএসএফ এর মাধ্যমে এই সকল সুবিধাগুলোর মূল্যায়ন করে পুনরায় চালু করা হবে।
উত্তরাধিকারের কথা বলতে গিয়ে তিনি নারীর ভূমি অধিকারটি ৫৪ বছরেও কিছু করা গেল না। এই ক্ষেত্রে তিনি ভূমি সংস্কারের উল্লেখ করে বলেন, এর মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা তাদের অসুবিধার কথা সহজে বলতে বা জানাতে পারবেন।
তিনি আরও বলেন, মন্ত্রণালয়ের দরজা সব সময় খোলা । আমরা একসাথে কাজ করতে পারি, আলোচনা করতে পারি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের (২০২২) তথ্যানুযায়ী মোট নারী শ্রমশক্তির ৭৪ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত। বাংলাদেশে কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে কৃষি কাজে সবচেয়ে বেশি নারী নিয়োজিত আছেন, যা দিন দিন আরও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাওরাঞ্চলে মৎস্য সম্পদ আহরণের সাথেও নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত আছেন। সুন্দরবন অঞ্চলে কাকড়া চাষ ও চিংড়ির ঘেরে নারীরা পুরুষদের চেয়ে বেশি শ্রম দিলেও মজুরি বৈষম্যের শিকার হতে হয়। চা বাগানে নারীরা চা শ্রমিকের কাজের পাশাপাশি নিজেরা সবজি উৎপাদন, গবাদিপশু পালন ও বাড়ির কাজ করে থাকেন। কিন্তু তাদের এই শ্রম, স্বাস্থ্য ঝুঁকি কখনো বিবেচনা করা হয়না। গ্রামীণ নারী কৃষকের কার্যকর স্বীকৃতি নেই। কৃষি ঋণ, প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, বা অন্যান্য কৃষি সেবায় এবং বাজারে নারীর প্রবেশাধিকার সামাজিকভাবে বাধাগ্রস্ত। নারী পুরুষ মজুরি বৈষম্য প্রকট। এ ছাড়াও চলতি বাজারে দৈনন্দিন মজুরি অনেক কম।
প্যানেল আলোচনায় মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, শুদ্ধকৃষি ব্যবস্থায় গ্রামীণ নারীদের যুক্ত করতে হবে। তাদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। কৃষিতে গ্রামীণ নারীদের অবদান থাকলেও সেই কৃষি জমরি মালিকানা কাদের হাতে থাকছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। নারী কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৈষম্য কিভাবে হ্রাস করা যাবে এবং তাদের সমমজুরি নিশ্চিত করা যাবে তার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
বিএলআরআই’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান ড. রেজিয়া খাতুন বলেন, কৃষিতে গ্রামীণ নারীরা শ্রম দেওয়া ৬০-৯০ শতাংশ। কিন্তু পণ্যের লভাংশ পুরো চলে যায় পুরুষের হাতে। ফলে নারীরা শ্রম বিনিয়োগ করেও সুফল ভোগ করতে পরছে না। তিনি আরও বলেন, নারীদের উন্নয়ন হতে হবে প্রযুক্তিভিত্তিক এবং এই বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষিতও করতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. রঞ্জন সাহা পার্থ বলেন, শুদ্ধ কৃষির সাথে গ্রামীণ নারী শ্রমের অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো। কিন্তু বাজার ব্যবস্থার সাথে কৃষি যুক্ত হওয়ার ফলে কৃষির ক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীর শ্রম প্রান্তিক অবস্থানে পৌঁছেছে। তিনি বাংলাদেশে এগ্রো টুরিজমের বা কৃষি পর্যটন তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, বাংলাদেশে এগ্রো টুরিজমের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীদের সম্পৃক্ত করার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের কৃষি ঋণ নীতিমালার আলোচনায় এএলআরডি-র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, শুধু কৃষি ঋণ নয়, গ্রামীণ নারী কৃষকের স্বীকৃতির ক্ষেত্রে আমাদের চলমান কার্যক্রম ও দাবি-দাওয়া অব্যাহত রাখতে হবে। এই নীতিমালার আওতায় সকল সরকারি ব্যাংকসহ অন্যান্য বেসরকারি ব্যাংককেও অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট অংশ যা নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে তা নিশ্চিত করতে হবে।
সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে খুশী কবির বলেন, আগেও যখন কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ ছিলো না তখনও নারীরা ফসল উত্তোলনের পরের সকল ধরনের কাজ করতো। এখন যখন কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ বেড়েছে তখনও নারীরা ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজের পাশাপাশি মাঠের কাজেও সমানভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এতে বোঝাই যায়, কৃষিতে নারীর অবদান অনস্বিকার্য। তারপরও নারীরা কৃষক হিসেবে অবমূল্যায়িত এবং যথাযথ স্বীকৃতি পাচ্ছেনা। ফলে নারীরা কৃষি ঋণ, কৃষি কার্ড ইত্যাদি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এতে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন তৃনমূলের নারী মনিরা বেগম, ফরিদপুর; সাবিনা হেমব্রম, দিনাজপুর; লামিয়া, পটুয়াখালী। এ ছাড়াও আসমা আক্তার মুক্তা, শাহদাৎ মন্ডল, বদরুল আলম, মাহবুব আলম, আরিফুজ্জামান, মেহনাজ মালা, লিপি প্রমুখ।
মন্তব্য করুন