সুপ্রিম কোর্টকে বলা হয় জনগণের ন্যায়বিচারের শেষ ভরসাস্থল। সেই ভরসাস্থলকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ারে পরিণত করা হয় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। উচ্চ আদালতের পরতে পরতে রয়েছে এই রাজনীতিকরণের প্রমাণ। আর এ কাজের গোড়াপত্তন হয় বিচারপতি নিয়োগের মধ্য দিয়ে। পুরোপুরি রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ হয় বিচারপতিদের। দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশই ছিল নিয়োগের অন্যতম শর্ত। যার আনুগত্য যত বেশি ছিল, নিয়োগে ছিল তার তত প্রাধান্য। আবার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারলেই তাকে দেওয়া হয়েছে পদোন্নতি। বিচারপতিরা নিজেদের শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ হিসেবেও ঘোষণা দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। এভাবে চরম দলীয়করণের প্রভাব পড়েছে বিচার কাজেও।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চরম দলীয়করণের কারণেই বিচার বিভাগে নজিরবিহীন ইতিহাস তৈরি হয়েছে। একযোগে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ছয়জন বিচারপতি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তবে এখনো হাইকোর্ট বিভাগে দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে জড়িত অনেক বিচারপতি তাদের পদে বহাল রয়েছেন। সে কারণে বিভিন্ন মহল থেকে তাদেরও পদত্যাগের দাবি উঠেছে।
সর্বশেষ গত ৭ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টে সাধারণ আইনজীবীদের ব্যানারে ৩০ বিচারপতির পদত্যাগ দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধন থেকে দলবাজ ও দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারপতিদের স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার আহ্বান জানানো হয়। অন্যথায় আগামী ১৮ অক্টোবর এসব বিচারপতির ছবিসংবলিত নামের তালিকা প্রকাশ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কর্মসূচি শেষে আইনজীবীদের একটি প্রতিনিধিদল সেসব বিচারপতির অপসারণে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রধান বিচারপতিকে স্মারকলিপি দেন।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, ‘তাজা রক্তের বিনিময়ে ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে আমরা দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আপনি এখন আমাদের বিচার বিভাগের অভিভাবক। কিন্তু নতুন বাংলাদেশে হাইকোর্ট বিভাগ ও বিচার বিভাগীয় প্রশাসন এবং অধস্তন বিচার বিভাগে বিচারক হিসেবে ফ্যাসিবাদী শাসনের সমর্থক ও সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে কিছু বিচারক। বিচারকের আসনে যখন আমরা তাদের দেখতে পাই তখন আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। এতে আরও বলা হয়, এসব বিচারক দায়িত্ব পালনে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন। তাই বিচার বিভাগের অভিভাবক হিসেবে আপনাদের কাছে আমাদের প্রথম ও প্রধান অনুরোধ এবং দাবি জানাচ্ছি, যে রক্তের ঋণ শোধের জন্য ‘জুলাই বিপ্লব, ২৪’ সংঘটিত হয়েছিল তার জন্য রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতা ও দুর্নীতির ভিত্তিতে এসব দলবাজ ও দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারপতিকে অবিলম্বে তাদের পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। যাতে ‘জুলাই বিপ্লবে’ প্রাণ উৎসর্গ ও রক্তের বলিদানকারীদের জীবন অর্থবহ করে তোলে।
জানা গেছে, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনার সরকার। এই পুরো সময়ে উচ্চ আদালতে যত বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে, তার প্রায় অধিকাংশই হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। বিচারপতি নিয়োগের কোনো নিয়মনীতি না থাকায় এই সুযোগ আরও বেশি করে কাজে লাগিয়েছে বিগত সরকার।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিচারপতি নিয়োগ হয় মূলত সিনিয়র জেলা জজ, অ্যাটার্নি জেনারেল কার্যালয়ে কর্মরত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনজীবীদের মধ্য থেকে। জেলা জজদের মধ্যে যারা সরকারের অনুগত ছিলেন, তারাই উচ্চ আদালতে নিয়োগে প্রাধান্য পেয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা এবং বিডিআর হত্যা মামলার মতো স্পর্শকাতর মামলায় নিম্ন আদালতে রায়প্রদানকারী বিচারপতিরা এখন উচ্চ আদালতে কর্মরত। এ ছাড়া আইনজীবী ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল থেকে যাদের নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ ছিলেন সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আবার কারও কারও কপালে ছিল ছাত্রলীগের তিলক। অনেকে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতাদের আত্মীয়স্বজন ও আশীর্বাদপুষ্ট।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর পরই ওয়ান-ইলেভেনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা সব দুর্নীতির মামলায় খালাস দেন হাইকোর্ট। আর এই রায়গুলোর বেশিরভাগ দিয়েছিলেন তৎকালীন বিচারপতি শামসুল হুদা মানিক। তিনি ১৯৮৬-৮৭ সালে গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। এরপর ২০১০ সালে ১১ এপ্রিল ১৭ জনকে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন বিগত সরকার। ১৮ এপ্রিল বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস বাবু ও খসরুজ্জামান ছাড়া বাকিদের শপথবাক্য পাঠ করান সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হত্যা মামলার আসামি বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস এবং চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৬ সালে প্রধান বিচারপতির এজলাস ও অ্যাটর্নি কার্যালয় ভাঙচুর মামলার আসামি হওয়ায় মো. খসরুজ্জামানকে সাবেক প্রধান বিচারপতি শপথ পাঠ করাননি।
পরে সাবেক সরকারের আরেক ঘনিষ্ঠ সহচর ও সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নকারী হিসেবে পরিচিত বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নিয়ে তাদের শপথ পাঠ করান। বিচারপতি খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ ত্রয়োদশ সংশোধনী, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলের বৈধতা প্রদান সংক্রান্ত পঞ্চম সংশোধনী এবং হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের শাসনামলের বৈধতা প্রদান সংক্রান্ত সপ্তম সংশোধনী বাতিল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে সাবেক সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। আর এর বিনিময়ে বিগত সরকারের পতন পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির সমান সুযোগ-সুবিধায় আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে যান।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি নুরুজ্জামান নোনি ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বাদলের বাড়ি কিশোরগঞ্জে হওয়ায় তারা সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের কোটায় নিয়োগ পান। এদের মধ্যে বিচারপতি নুরুজ্জামান নোনি ঢাকা আইনজীবী সমিতির আওয়ামী ফোরাম থেকে সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া জাহাঙ্গীর হোসেন বাদল অধস্তন আদালতের অন্তত ৬০ জন সিনিয়র জেলা জজকে ডিঙিয়ে নিয়োগ পান। সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের আপন বড় ভাই বিচারপতি মাহমুদ হাসান তালুকদার এখন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি। সাবেক ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার জামাই বিচারপতি খুরশীদ আলম সরকার। আর বিচারপতি খুরশীদ আলম সরকারের ভগ্নিপতি বিচারপতি রিয়াজ উদ্দিন খান। সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের ভাতিজি জামাই বিচারপতি জাফর আহমেদ।
বিচারপতি খিজির হায়াত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন এমন অনেকেও রয়েছেন হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে। বিচারপতি সর্দার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীর ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের এমপি সর্দার মো. জাহাঙ্গীরের ছেলে। ব্যারিস্টার তাপসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত বিচারপতি এ কে এম রবিউল হাসান। সাবেক আইনমন্ত্রী ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত এবং গোপালগঞ্জে বাড়ি হওয়ায় নিয়োগ পান কে এম ইমরুল কায়েস। বিচারপতি মো. বদরুজ্জামান ছাত্রলীগের নেতা ও তার স্ত্রী সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জান্নাতুল ফেরদৌসী রূপা। এই রূপার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এবং সে দুবার বগুড়া থেকে আওয়ামী লীগের নমিনেশন চেয়েছিলেন। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি বিশ্বজিত দেবনাথসহ বেশ কয়েকজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল। তাদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৬ জুলাই ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে আওয়ামী সরকার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিচারপতি খন্দকার দিলীরুজ্জামানকে দিয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে। এই কমিশনকে দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতের তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার উদ্দেশ্য ছিল সাবেক সরকারের।
সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করলেই পদোন্নতি : একদিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ, আর অন্যদিকে সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করলেই পদোন্নতির দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পদোন্নতির লোভে অনেক বিচারপতিই নিজের বিচারিক সত্তাকে ভুলে দলীয় সত্তাকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে কাজ করেছেন। আর এই প্রবণতা অনেক বিচারককে অতিমাত্রায় রাজনীতিতে ঝুঁকতে সহায়তা করেছিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার করা হবে। আর সেই ইশতেহার বাস্তবায়নে সরকার ২০১০ সালে গঠন করে যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনাল। সরকারের এই রাজনৈতিক ইশতেহার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দলীয় ঘেঁষা বিচারপতিদের নিয়োগ দেওয়া হয় ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি হিসেবে। স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর পর অনেকটাই তথ্য-উপাত্তহীন ঘটনার বিচার করতে গিয়ে অনেক বিতর্কের জন্ম দেয়। আর সেই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন বিচারপতিরা। তাদের দেওয়া রায় দেশে-বিদেশে সমালোচিত হয়েছে। দিন শেষে রায় প্রদানকারী বিচারপতিদের অনেকেই পরে পদোন্নতি পেয়ে আপিল বিভাগের বিচারপতি হয়েছেন। সর্বশেষ গত ১০ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের মুখে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, জাহাঙ্গীর হোসেন, মো. শাহিনুর ইসলাম ও কাশেফা হোসেন পদত্যাগ করেন। এই ছয় বিচারপতির মধ্যে চারজনই ছিলেন যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক। বাকি দুজনের মধ্যে বিচারপতি কাশেফা হোসেন সজীব ওয়াজেদ জয়ের টিচার ছিলেন বলে কথা প্রচলিত রয়েছে আদালত অঙ্গনে।
এদিকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে সাজা দেন বিচারক মো. আখতারুজ্জামান। পরে তাকে পদোন্নতি দিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে আনা হয়। এ ছাড়া আরেকটি রাজনৈতিক মামলা হিসেবে পরিচিত একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় দেন বিচারক মো. শাহেদ নুর উদ্দীন। এ মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনকে ফাঁসির আদেশ দেন তিনি। এ ছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে দেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন তিনি। তাকেও পরে হাইকোর্টের বিচারপতি বানিয়ে আনা হয়।
একইভাবে প্রায় একই সময়ে যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীন ও বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। একই সময়ে দায়িত্ব পালন করলেও বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনকে আপিল বিভাগে নিয়োগের পর দীর্ঘদিন হাইকোর্টেই থাকেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে নিম্ন আদালতের দেওয়া ৫ বছরের সাজার রায় বৃদ্ধি করে ১০ বছর করে রায় দেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। এরপর বিচারপতি ইনায়েতুর রহিমকে আপিল বিভাগে নিয়োগ করা হয়। এভাবে সরকারের উদ্দেশ্য যারা বাস্তবায়ন করেছেন, তাদের বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করতে দেখা গেছে বিগত সরকারের আমলে। আর এ কারণেই অতিমাত্রায় রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা। গত বছর ১৫ আগস্টে শোক দিবস পালন অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করতে গিয়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম নিজেদের শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ হিসেবে উল্লেখ করে করেন। অনুষ্ঠানে বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের যে মৌলিক অধিকার জনগণের রয়েছে তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেন, ‘সারা পৃথিবীতে নির্বাচন হয়, কেউ তাকিয়েও দেখে না; কিন্তু নির্বাচন ঘিরে সব নজর বাংলাদেশের দিকে কেন? এ ছাড়া বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার জামায়াতের বিচার করতে গিয়ে যদি গুলি খেতেও হয়, তাহলেও বুক পেতে দিতে প্রস্তুত উল্লেখ করে ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বক্তব্য শেষ করেন। এরপর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি জাফর আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা সভা-সমাবেশ করেন।
এদিকে বিচার বিভাগের দলীয়করণ নিয়ে মুখ খুলে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে দেশত্যাগ করতে হয়েছে। ষোড়শ সংশোধনীর মামলার শুনানিকালে বিচারপতি এস কে সিনহা বলেছিলেন, সরকার নিম্ন আদালতকে কবজায় নিয়েছে, এখন উচ্চ আদালতকেও তাদের কবজায় নিতে চায়। এই অপ্রিয় সত্য প্রকাশ করার পর তার ওপর শাস্তির খড়্গ নেমে আসে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ির লিজ চুক্তি বাতিলের রায়ের সমালোচনা করে আপিল বিভাগের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হয়েছে সাবেক বিচারপতি শরীফ উদ্দিন চাকলাদারকে। এভাবে তিরস্কার-পুরস্কারের মাধ্যমেও রাজনৈতিকভাবে বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন: জানতে চাওয়া হলে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন কালবেলাকে বলেন, উচ্চ আদালতে রাজনৈতিকভাবে বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে এবং চরম দলীয়করণ হয়েছে—এটাই সত্য। জনগণও এটাই মনে করে। আর এজন্যই জনগণের দাবির মুখে আপিল বিভাগের ছয়জন বিচারপতি পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। সাবেক এই বিচারপতি আরও বলেন, যাদের সরকার পছন্দ করেছে, তাদেরই বিচারপতি বানিয়েছে। আর এ কারণে তাদের মাধ্যমে সরকার তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেছে। আর দীর্ঘদিনেও বিচারপতি নিয়োগে কোনো আইন না করায়, এটা সম্ভব হয়েছে। সরকার আইন না থাকার সুযোগ নিয়েছে। বিচারপতি নিয়োগের আইন করা হলে এই সংকট কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে।
এদিকে গতকাল আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের অনেক বিচারপতি ফ্যাসিবাদী সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে তাদের পদত্যাগের দাবি উঠেছে। এসব বিচারপতির বিরুদ্ধে আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে সুপ্রিম কোর্টের নিজেদেরই ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেন।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সহ-সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব কালবেলাকে বলেন, বিগত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনা বিচার বিভাগকে তার অধীন করার একটি প্রকল্প হাতে নেন। তার ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম ও তা বহাল রাখার জন্য বিচারপতি থেকে শুরু করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ পর্যন্ত তিনি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। প্রধান বিচারপতিসহ ৬ জন পদত্যাগ করলেও ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হিসেবে যারা কাজ করেছেন, তাদের অনেকেই এখনো উচ্চ আদালতে বহাল রয়েছেন। এটা আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের অনতিবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। একই সঙ্গে বিচার ব্যবস্থাকে জনগণের বিচার ব্যবস্থায় পরিণত করতে হলে বিচারপতি নিয়োগের আইন এবং তাদের অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সচল করতে হবে। ব্যক্তি পছন্দে বিচারপতি নিয়োগ হলে আমরা সেই পুরোনো বৃত্ত থেকে কখনোই বের হতে পারব না।
মন্তব্য করুন