রিক্রুটিং লাইসেন্সে শ্রেণিবিন্যাসের আইন নতুন করে বাস্তবায়নের চেষ্টার প্রতিবাদে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা)-এর সদস্যরা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে।
বুধবার (০৯ অক্টোবর) বেলা ১১টায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সামনে এ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়।
এতে বক্তারা বলেন, রিক্রুটিং লাইসেন্স শ্রেণিবিন্যাস বৈষম্যবিরোধী সরকারের নীতির পরিপন্থি। আমাদের দাবি, সবাই সমান সুযোগ পাবে। পাঁচই আগস্ট ছাত্র-জনতার সংগ্রাম ও রক্তের বিনিময়ে দেশকে বৈষম্যমুক্ত করার জন্য এই সরকারের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তাই এই সরকারের মাধ্যমে কোনো বৈষম্য হোক তা আমরা চাই না। এই ধরনের বৈষম্য কোনোভাবেই বাস্তবায়ন করা যাবে না।
তারা বলেন, দেশের সকল রিক্রুটিং এজেন্সি দেশের প্রচলিত আইনে, সরকার নির্ধারিত জামানত দিয়ে সমঅধিকারের ভিত্তিতে লাইসেন্স পেয়েছে। লাইসেন্সের শ্রেণিবিন্যাসের মূল ভিত্তি হিসেবে অধিক সংখ্যক কর্মী প্রেরণকে মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু সৌদি, কুয়েত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে সীমিত সংখ্যক এজেন্সিকে কর্মী প্রেরণের সুযোগ করে দেওয়ায় অধিকাংশ রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী প্রেরণের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বক্তারা এই সেক্টরকে বৈষম্যহীনভাবে পরিচালিত করার জন্য রিক্রুটিং লাইসেন্সের অনৈতিক শ্রেণিবিন্যাস বন্ধ করে ব্যবসার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি জানান।
মানববন্ধন কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন বায়রার যুগ্ম মহাসচিব টিপু সুলতান, বায়রার সাবেক মহাসচিব কাজী মফিজুর রহমান, বায়রার কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আবুল বাশার, বায়রার সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক কে এম মোবারক উল্লাহ শিমুল, বায়রার ইসি সদস্য আরিফুর রহমান, বায়রার অন্যতম সদস্য আতিকুল ইসলাম, বায়রা কল্যাণ পরিষদের সদস্য লিমা আক্তার, মেজবাউদ্দিন, শান্তদেব সাহা, ফাতেমা বেগম প্রমুখ।
টিপু সুলতান বলেন, ‘আজকে বৈষম্যবিরোধী সরকার যেখানে রয়েছে সেখানে বায়রাতে কেন বৈষম্য সৃষ্টি করা হবে? ২০১৩ সালে এই শ্রেণিবিন্যাসের আইন করেছিল তৎকালীন সরকার। সেই সময় আমাদের তীব্র আন্দোলনের কারণে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। শতশত ছাত্র জনতা রক্ত দিয়েছে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনের জন্য। আজকে এই বৈষম্যমূলক আইন বাস্তবায়ন করতে চাইছে আমরা তার প্রতিবাদ জানাছি। এই শ্রেণিবিন্যাস কি কারণে হবে? যে তিন হাজার লাইসেন্স আছে তারা কি সবাই সকল দেশে কর্মী প্রেরণ করতে পেরেছে? সকলে কি সৌদিতে কর্মী প্রেরণ করতে পেরেছে? সবাই কি সিঙ্গাপুরে কাজ করতে পারছে, মালয়েশিয়ায় কাজ করে? সরকারি প্রতিষ্ঠান বোয়েসেল নিজেইে এখন সিন্ডিকেটে ঢুকে গেছে। আইনের দোহাই দিয়ে শ্রেণিবিন্যাসের অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হবে, না হলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।’
বায়রার সাবেক মহাসচিব কাজী মফিজুর রহমান বলেন, ‘১৯৮০ সাল থেকে ব্যবসা করছি, শ্রেণিবিন্যাস কি বুঝতে পারিনি। ওনারা আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন, আমাদের চেকলিস্ট দিয়েছেন, ওনারা মার্কিং করে আমাদের শ্রেণিবিন্যাস করবেন। আমি মনে করি এটা কোনভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়, সম্ভবও নয়। যেহেতু স্বৈরাচারী সরকার এটা করতে পারেনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত এই সরকারও তা পারবে না। এই অপকৌশল থেকে সরকার বিরত থাকবে এটাই আমার প্রত্যাশা। কেননা এটা আমাদের আত্মমর্যাদার বিষয়, আমরা সবাই লাইসেন্স হোল্ডার, এতে আমাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হবে। অধিকার ক্ষুণ্ন হয় এমন কিছু আমরা করতে দেব না।’
বায়রার কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আবুল বাশার বলেন, ‘এই কালো আইন রহিত করা হোক। সবাই যাতে সমানভাবে কাজ করতে পারে, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে পারে সেজন্য সরকারকে সুযোগ করে দিতে হবে। ’
বায়রার সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক কে এম মোবারক উল্লাহ শিমুল বলেন, ‘এই আইন নতুন করে করা হয়নি, ২০১২/১৩ সালে করা হয়েছে। খন্দকার মোশাররফ হোসেন মন্ত্রী থাকার সময়। ওই মানবপাচার আইনের কিছু ধারা আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন এটি সংস্কারের সরকার। সরকারের কতিপয় দুষ্ট প্রকৃতির লোক তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। এটা হলে আমাদের মধ্যে বিভাজন হবে, সংঘাত সৃষ্টি হবে। এটা সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।’
বায়রার ইসি সদস্য আরিফুর রহমান বলেন,‘আমাদের মূল দাবি হচ্ছে লাইসেন্সে যে শ্রেণিবিন্যাস, এ বি সি ডি ক্যটাগরি তৈরি করা হচ্ছে তা আমরা চাই না। এতে এখানে বৈষম্য তৈরি হবে। বিগত সরকার যখন অভিবাসী আইন ২০১৩ করে ওই আইনে শ্রেণিবিন্যাসের প্রস্তাবনা ছিল। অভিবাসী আইনসহ শ্রেণিবিন্যাস বাতিল করতে হবে। সবার জন্য ব্যবসার সমান সুযোগ তৈরি না করে, ব্যবসার সমান পরিবেশ তৈরি না করে এই ধরনের শ্রেণিবিন্যাস বৈষম্যকে বাড়িয়ে তুলবে। এটা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলতে থাকবে। ’
বায়রার অন্যতম সদস্য আতিকুল ইসলাম বলেন,‘বিগত সরকার ২০১৩ সালের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন-২০১৩ এর ৪৮ নস্বর আইনের ধারা ১৬/১,২,৩ এ রিক্রুটিং এজেন্টের শ্রেণিবিন্যাস করে চরম বৈষম্যের সৃষ্টি করে। কিন্তু ওই ধারা প্রণয়নে প্রধান স্টেকহোল্ডার রিক্রুটিং এজেন্সি তথা বায়রার সদস্যদের সাথে কোন আলোচনা করেনি। আমাদের আন্দোলনের কারণে বিগত ১২ বছরে এই কালো আইন বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আজকে নতুন করে তা করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে।’
ফাতেমা আক্তার লিমা বলেন,‘আমরা শ্রেণিবিন্যাস চাই না। শ্রেণিবিন্যাস হলে এই সেক্টরের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতি হবে। লাইসেন্সের মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। লাখ লাখ লোক বিদেশে কাজ করে রেমিট্যান্স পাঠায়, আমরা নিজেরা এর কারিগর। আমরা সবাই সমঅধিকারের ভিত্তিতে কাজ করতে চাই।’
মেজবাউদ্দিন বলেন, পুরোনো সমস্যাগুলো সমাধান না করে তারা নতুন নতুন সমস্যা তৈরির পাঁয়তারা চালাচ্ছে। শ্রমবাজারকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। যে শ্রমবাজারগুলো বন্ধ হয়ে গেছে সেগুলো খোলার বিষয়ে জোর দাবি জানাচ্ছি।’
শান্তদেব সাহা বলেন, ‘আজকে যখন রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা তার ঘর ভাড়া দিতে পারছেন না, কর্মচারিদের বেতন দিতে পারছেন না, বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজার বন্ধ হচ্ছে তখন শ্রেণিবিন্যাসের ইস্যু তোলা হচ্ছে কেন? ২০১৩ সালে আইন হলেও এতোদিন তা বাস্তবায়ন হয়নি, এখন কে বা কারা এটা করছে এটা আমার প্রশ্ন। এই তৎপরতা বন্ধ করে নতুন নতুন শ্রমবাজার কিভাবে খোলা যায়, ইউরোপের অনেক দেশের এম্বাসি আমাদের দেশে নেই, সেইসব দেশের এম্বাসি কিভাবে এই দেশে আনা যায় তার ব্যবস্থা করেন।’
মানববন্ধন কর্মসূচি শেষে এক প্রতিনিধি দল প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করেন। স্মারকলিপিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মী প্রেরণে সকল রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য সম-অধিকার বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত লাইসেন্স শ্রেণিবিন্যাস করার উদ্যোগকে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত অনভিপ্রেত ও বাস্তবতা বিবর্জিত বলে উল্লেখ করা হয়। এই শ্রেণিবিন্যাস বাস্তবায়ন রহিত করার জন্য উপদেষ্টার কাছে জোর দাবি জানানো হয়।
মন্তব্য করুন