বাসস
প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৩০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

শেষ আশ্রয়টুকুও হারালেন শহীদ দেলোয়ারের বৃদ্ধা মা

দেলোয়ার হোসেন। ছবি : সংগৃহীত
দেলোয়ার হোসেন। ছবি : সংগৃহীত

স্বামীহারা জিন্নাতুন নেছা ছোট ছোট ছেলেদের নিয়ে ২৬ বছর অনেক কষ্ট ও সংগ্রাম করেছেন। তাদের মানুষ করেছেন। বার্ধক্যের এই দিনগুলোতে ছেলে দেলোয়ারের কাছে একটু স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনযাপন করছিলেন। সেই সন্তানের মৃত্যুতে হারিয়ে গেছে তার আহ্লাদ আর স্বাচ্ছন্দ্যের এই আশ্রয়টুকু। দেলোয়ারের মৃত্যুর দুই মাস পেরিয়ে গেছে। কান্না থামেনি মায়ের। বারবার ছুটে যাচ্ছেন ছেলের কবরের পাশে। আর বিলাপ করছেন, আমার আদরের ছেলেকে কেন হত্যা করল? এখন কে আমাকে ওষুধ কিনে দিবে? আমি কার কাছে থাকব? মায়ের এ আহাজারি আর আর্তস্বরে ভারী হয়ে উঠছে চারপাশ।

ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা জিন্নাতুন নেছা ও পিতা মরহুম সুলতান আহমেদের ছেলে শহীদ দেলোয়ার হোসেন (৩৫)। মা, স্ত্রী ও তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে ঢাকার মিরপুরে বসবাস করতেন। সেখানেই তার ফার্নিচারের দোকান ছিল।

দেলোয়ারের স্ত্রী লিজা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বাসসকে জানান, তার স্বামী গত ১৯ জুলাই বিকাল ৪টার দিকে ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বরে দোকানের মালামাল কিনতে যান। রিকশা থেকে নামার পরে গোল চত্বরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে মানুষের হুড়োহুড়িতে মাটিতে পড়ে যান। এ সময় তার তলপেটে তিনটি গুলি লাগে। স্থানীয়রা উদ্ধার করে একে একে তিনটি হাসপাতালে নিলেও কোথাও কেউ তাকে চিকিৎসা দিতে রাজি হয়নি। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় দেলোয়ারের। পরে তাকে শ্যামলী সিটি কেয়ার জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। ওই দিন রাতেই দেলোয়ারের শরীরে অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু ২১ তারিখ সকাল পৌনে ৮টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেলোয়ার ইন্তেকাল করেন। পরে লাশ ভোলা সদরে গ্রামের বাড়িতে ওই রাতেই দাফন করা হয়।

জানা যায়, স্বামীহারা জিন্নাতুন নেছার (৬৯) পাঁচ ছেলের মধ্যে শহীদ দেলোয়ার আর্থিকভাবে অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল ছিলেন। তাই মা জিন্নাতুন নেছাকেও নিজের ঢাকার বাসায় এনে রেখেছিলেন। মায়ের থাকা, খাওয়া, ওষুধ, চিকিৎসার পুরোটাই বহন করতেন দেলোয়ার। মায়ের জন্য তার আহ্লাদও যেনো অন্য ভাইদের চেয়ে একটু বেশিই ছিলো। দেলোয়ারের মৃত্যুর পরে মা এখন ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড এলাকার দিনমজুর ছেলে আনোয়ারের সঙ্গে থাকেন। টাকার অভাবে এখন আর নিয়মিত ওষুধও খেতে পারেন না।

সরেজমিনে দেলোয়ারের বড় ভাই আনোয়ার হোসেনের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় জিন্নাতুন নেছার সাথে। বয়সের কারণে নানান শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে তার। দেলোয়ারের কথা উঠতেই কেঁদে ওঠেন মা ।

তিনি বাসসকে জানান, দেলোয়ারের বাবা সুলতান আহমেদ প্রায় ২৬ বছর আগে আরেকটি বিয়ে করে অন্যত্র চলে যান। ৫টি ছেলে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। শ্বশুর বাড়িতে থেকেই অনেক সংগ্রাম করে ছেলেদের বড় করেছেন। পাঁচ ছেলের মধ্যে দেলোয়ার ছিল চার নম্বর।

তিনি আরও জানান, একটু বড় হওয়ার পর থেকে দেলোয়ার ঢাকায় গিয়ে ফার্নিচারের দোকানে কর্মচারীর কাজ নেন। গত কয়েক বছর আগে নিজেই ঢাকার মিরপুরে একটি ছোটখাটো ফার্নিচারের দোকান দেন। তার আগে থেকেই ছেলে মাকে তার কাছে নিয়ে যায়। দেলোয়ার সবসময় নিজেই মায়ের খাওয়া-দাওয়া ও শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর রাখতেন। দেলোয়ারের বড় ভাই দিনমজুর আনোয়ার বলেন,আমার মা সারাদিন দেলোয়ারের কথা বলে কান্নাকাটি করে। ছুটে যেতে চায় বারবার ভাইয়ের কবরের পাশে। বয়স হয়ে যাওয়াতে শিশুর মত করছে মা।

এ ছাড়া দেলোয়ারের স্ত্রী তিনটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। তাই তাদের সম্মানের সঙ্গে জীবন যাপন করার জন্য সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, আমাদের কারো আর্থিক সচ্ছলতা নেই । ছোটবেলা থেকেই অভাবের সংসার। আমার অন্য ভাইয়েরা জেলে, কাঠমিস্ত্রি ও কৃষিকাজ করে। এই ভাইয়ের অবস্থা একটু ভালো ছিলো। সে মা ও পরিবারের সবার খেয়াল রাখতো। তিনি জানান, বাবা সুলতান আহমেদের মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া কোনো সম্পদ তারা পাননি। সব নিয়ে নিয়েছে দ্বিতীয় পরিবারের সন্তানেরা। তাই তাদের তেমন কোনো সম্পদ নেই।

এ দিকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে রাব্বি হাসান, ছয় বছরের মেয়ে হাসনুর ও ১৮ মাস বয়সী ছেলে হোসাইনকে নিয়ে আর্থিক সংকটে রয়েছেন দেলোয়ারের স্ত্রী লিজা। চিকিৎসাতেই ব্যয় হয়েছে প্রায় চার লাখ টাকা। তার ওপর তিন ছেলেমেয়ের পড়ালেখা, খাওয়া। সামনের দিনগুলো কিভাবে চলবে তাই ভেবে দিশাহারা লিজা।

লিজা জানান, দেলোয়ারের হাসপাতালে চিকিৎসা, ওষুধ, অপারেশন, মৃতদেহ অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়ি নিয়ে যাওয়াসহ সব মিলিয়ে প্রায় চার লাখ টাকার মত খরচ হয়েছে। পুরো টাকাই ধার দেনা করে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এখন সেই টাকাই বা কিভাবে পরিশোধ করবেন? ইতোমধ্যে তিনি দেলোয়ারের ফার্নিচারের দোকানটিও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

শহীদ দেলোয়ারের বড় ভাইয়ের স্ত্রী বিউটি বেগম জানান, দেলোয়ারের ভাইয়েরা সবাই গরিব মানুষ। তাদের পক্ষে চার লাখ টাকা পরিশোধ করা সম্ভব নয়। তিনি দেবর শহীদ দেলোয়ারের পরিবারের জন্য সরকারি সহায়তার দাবি জানান।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

১০০ আসনে নারীদের সরাসরি নির্বাচন চায় এনসিপি

সরিয়ে দেওয়া হলো স্বাস্থ্য উপদেষ্টার এপিএসকেও

রেকর্ড ভেঙে সোনার দামে নতুন ইতিহাস

আরেক দেশকে নিয়ে ‘বিশাল যুদ্ধ মহড়ায়’ যুক্তরাষ্ট্র

বাকেরগঞ্জে কারখানা নদীর বালুমহাল ইজারা বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন

টানা পাঁচ দিন ঝরবে বৃষ্টি    

কালবৈশাখী ঝড়ে লণ্ডভণ্ড মিরসরাই

মেজর সিনহা হত্যা মামলার আপিল শুনানি বুধবার

লেভানডভস্কির চোটে বার্সা শিবিরে দুঃশ্চিন্তা

ডিসি শাকিলাকে রেলওয়ে পুলিশে বদলি

১০

ছাত্রদলে পদ পেতে স্ত্রীকে তালাক, ফয়সাল রেজার অব্যাহতি

১১

কালীগঞ্জে জামায়াতে ইসলামীর প্রস্তুতি সভা

১২

প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ধর্মগুরু হন পোপ ফ্রান্সিস

১৩

পূর্ব শত্রুতার জেরে কৃষকের পাকা ধান কেটে নিল প্রতিপক্ষ

১৪

তুরস্কের ভয়ংকর ড্রোনের জনক কে এই সেলচুক বায়রাকতার

১৫

হত্যা মামলায় আ.লীগ নেতা বাবা-ছেলে রিমান্ডে

১৬

ঢাকা-রিয়াদ সরাসরি ফ্লাইট শুরু করল ইউএস বাংলা

১৭

এসএসসি পরীক্ষার এক কেন্দ্রেই সাত পরিদর্শক বহিষ্কার

১৮

গণতন্ত্র হত্যাকারী খাইরুল এখনো আইনের আওতায় আসেননি : কায়সার কামাল

১৯

দাম সমন্বয় ছাড়া ওষুধ শিল্প বাঁচবে না : হালিমুজ্জামান

২০
X