একাত্তর ইস্যুতে পাকিস্তান দুঃখ প্রকাশ করলে সম্পর্ক আরও সহজ হবে এবং সামনে এগিয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ও সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।
পাকিস্তানের হাইকমিশনার সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বার্তা দিয়েছেন। তবে তারা ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য এখনো ক্ষমা চায়নি; এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ৫২ বছরের একটা বিষয় সেটা কাল সমাধান হবে বলে আমি মনে করি না। তবে যখন আমরা আলোচনার টেবিলে বসব, তখন ইস্যুটি থাকতে হবে। পাকিস্তানের হাইকমিশনার যে বক্তব্য দিয়েছেন, এ ধরনের কাছাকাছি বক্তব্য তাদের নেতাদের কাছ থেকে আগেও এসেছে।
তৌহিদ হোসেন বলেন, আমি মনে করি পাকিস্তান যদি এ সাহস টুকু দেখায়, এখানে ১৯৭১ সালে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা উদ্ধৃত করে তারা আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী হয়, এটাতে দোষের কিছু নেই। জাপান তাদের কৃতকর্মের জন্য গত ৭০ বছর ধরে মাফ চেয়ে আসছে। পাকিস্তানও যদি এমন দেখাতে পারে তাহলে সম্পর্ক স্বাভাবিক ও সহজ হয়ে আসবে। আবার এ কারণেই যে সম্পর্ক আটকে রাখা সেটারও কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা তো সম্পর্ক বজায় রেখেও আসছি। তবে স্বার্থ বজায় রেখেই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এখানে আমাদেরও স্বার্থ আছে, তাদেরও আছে। সব কিছুই দেখতে হবে।
এ সময় বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের বিতর্কিত বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘নিজেদের স্বার্থে সুসম্পর্ক রাখতে চায় বাংলাদেশ-ভারত। আগামী মাসে বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশনের (বিমসটেক) সামিটে দুই সরকার প্রধানের দেখা হতে পারে।’
এ ছাড়া সম্প্রতি নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বৈঠক করেছেন। সেই বৈঠকে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত আনার বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলেও জানান তৌহিদ হোসেন।
বৈঠকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত আনার বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, তাকে (শেখ হাসিনা) ফেরত আনার বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
জয়শঙ্করের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে তিনি জানান, আমরা আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথাবার্তা বলেছি। আমরা উভয়পক্ষ একমত হয়েছি, আমাদের পরস্পরের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন নিজেদের স্বার্থে। বিষয়টিতে বাংলাদেশের স্বার্থ আছে, ভারতেরও স্বার্থ আছে। কাজেই আমরা এই লাইনে কথাবার্তা বলেছি। আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করে পারস্পরিক যে উদ্বেগ আছে সমাধানের চেষ্টা করব। এ রকম কথা হয়েছে।
ভিসা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, তারা ভিসা নিয়ে কথা বলেছেন। এখন মেডিকেল ভিসা চালু আছে। ভিসা দেওয়ায় অনেকে ভারতে চলে গেছেন। তারা আশা করছেন, কিছুদিনের মধ্যে এটা চালু হয়ে যাবে। তারা সব ভিসা চালু করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেছে। হয়ত বেশিদিন লাগবে না।
পাশাপাশি নিরাপত্তা নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে বলেও জানান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, তাদের জানানো হয়েছে যে প্রথম অবস্থায় সরকার ছিল না কিছুদিন। পুলিশ ছিল না অনেক দিন। এগুলোর কারণে নিরাপত্তায় কিছু সমস্যা হয়েছে, এটা আমরা স্বীকার করি। এখন পুলিশ অনেকাংশ ফিরে এসেছে। সেনাবাহিনী এখনো আছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখন অনেক উন্নত হয়েছে। নিরাপত্তা নিয়ে ইদানীং বিদেশি কারও কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পাইনি। সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ছয় সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের পরে জানানো যাবে বলে জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই। ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং তাদের তিন মাস সময় দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে তারা ডিসেম্বরের শেষে অথবা জানুয়ারির শুরুতে তাদের সুপারিশগুলো দেবে। আরও কিছু স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন আছে। তখনই কিন্তু রোডম্যাপ ঠিক করা যাবে। তার আগে রোডম্যাপ ঠিক করা যাবে না।
নির্বাচন কবে হবে এ বিষয়ে বিদেশিরা জানতে চেয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবার সঙ্গে আমরা বিষয়গুলো এমনভাবে উপস্থাপন করেছি যে তাদের বেশি কিছু বলার ছিল না। আমরা তাদের প্রেক্ষাপট বলেছি। এ সরকার আসতে চায়নি এবং নিজে থেকে আসেনি।’
উপদেষ্টা বলেন, যুব সম্প্রদায় কিছু জিনিস চায় এবং তারা এমন একটি ব্যবস্থা চায় যেখানে স্বৈরাচারী সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও তারা সংস্কার চায়। আমাদের এজেন্ডার সঙ্গে তাদের চাওয়া মেলে। আমরা গোটা বিষয়টি তাদের খুলে বলেছি এবং জানিয়েছি এরপরে নির্বাচন দিয়ে আমরা এখান থেকে সরে যাব।
এসময় তিনি আরও জানান, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বিভিন্ন বাংলাদেশি গ্রুপের সঙ্গে কথা হয়েছে এবং সবাই জোর দিয়েছে যে আমরা যেন এ ব্যাপারে (নির্বাচন) তাড়াহুড়ো না করি।
যুক্তরাষ্ট্র সফর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই সফরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ বিশ্ব সম্প্রদায়ের সবাই প্রফেসর ইউনূসের কাছে শুনতে চাইছিলেন যে কী ঘটছে বাংলাদেশে এবং তার পরিকল্পনা কী। এটি আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে এর আগে বলেছি। কিন্তু তিনি সরাসরি হাজির হয়ে বলা এবং অন্য মাধ্যমে বার্তা পাঠানোর মধ্যে পার্থক্য আছে।’
উপদেষ্টা জানান, হঠাৎ করে কিছু অর্জিত হয়ে যায় না। আমি এটুকু বলতে পারি যে যারা দেখা করেছেন এবং যারা এককভাবে দেখা করেননি তারা সবাই বাংলাদেশের এই মূহূর্তে সার্বিকভাবে সহায়তার কথা বলেছেন এবং জানতে চেয়েছেন তারা কী করতে পারেন।
রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়ে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নিহিত সীমান্তের ওপারে। সমাধান আমাদের এখানে নেই। আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। তারা যাতে মানবিক জীবন যাপন করতে পারে, সেজন্য তাদের সহায়তা করা হচ্ছে এবং আমরাও সহায়তা করছি। কিন্তু সমাধান মিয়ানমারে রয়েছে। তাদের ফিরে যেতে হবে এবং এর জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরির বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
মন্তব্য করুন