জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের হাসপাতালে গিয়ে দেখার পর তাদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে কান্নায় আপ্লুত হয়ে পড়েন সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী।
তিনি বলেন, আজকে এখানকার পরিবেশ খুবই বেদনাবিধুর। খুবই কঠিন মুহূর্ত যখন পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য তারা তাদের জীবন দিয়েছে। এ সামান্য উপঢৌকন তাদের পরিবারের জন্য কিছু না।
রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত সাংবাদিকদের স্মরণ এবং তাদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান উপলক্ষে ‘স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনে সাংবাদিক সমাজের ভূমিকা ও বর্তমান করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন ‘লাভ শেয়ার বিডি-ইউএস’।
জাতীয় প্রেস ক্লাব এবং সাংবাদিকদের পেশাগত অধিকার বিষয়ক সংগঠন ‘জার্নালিস্ট ফর জাস্টিস’ এর সহযোগিতা করে। অর্থ সহযোগিতা হিসেবে ঢাকা টাইমস’র সিনিয়র রিপোর্টার হাসান মেহেদী, দৈনিক নয়া দিগন্তের সিলেট প্রতিনিধি আবু তাহের মো. তুরাব, দৈনিক খবরপত্রের রায়গঞ্জ প্রতিনিধি প্রদীপ কুমার ভৌমিক, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়, গাজীপুর ভিত্তিক দৈনিক ভোরের আওয়াজ পত্রিকার সাংবাদিক শাকিল হোসেনের পরিবারকে এক লাখ করে টাকা দেওয়া হয়।
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ এবং পরিচালনা করেন সাংবাদিক জাহেদ চৌধুরী।
আলোচনা সভায় মুশফিকুল ফজল আনসারী বলেন, আপনারা হয়তো এখানে বসে অনেক কথা বলছেন, অনেকের মনে সুপ্ত বাসনা পূরণ করতে চেষ্টায় আছেন। আমি গত শনিবার হাসপাতালে গিয়েছিলাম। দেখে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। হাত-পা নেই, অঙ্গহানি ও পঙ্গু হয়েছে অনেক ছাত্র-জনতা। দুই পা নেই, কেটে ফেলতে হয়েছে, উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। উল্টে উঠে একটি হাসি দিয়ে বললো, ‘ব্রাদার উই আর মেরিট’। কি ভালোবাসা আর দেশ নিয়ে, কি প্রেম তাদের দেশের প্রতি।
প্রত্যেক শহীদ ও আহতদের পরিবারের জন্য সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রয়োজনে হাসপাতালে যারা কাতরাচ্ছেন তাদের বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে সরকারের পক্ষ থেকে, দেশের জন্য যারা রক্ত দিয়েছেন তার পরিবার আবার টাকা দিয়ে চিকিৎসা-ওষুধ কিনবে, এটা মেনে নেওয়া হবে না।
আলোচনা সভায় নিহত গাজীপুর ভিত্তিক দৈনিক ভোরের আওয়াজ পত্রিকার সাংবাদিক শাকিল হোসেনের বাবা বলেন, আমার ছেলের লাশ দিতে চায়নি, পরে লাশ দিলেও জানাজার জন্য সময় দিতে চায়নি। পরে জনগণের চাপে সময় দিতে বাধ্য হয় প্রশাসন।
ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক হাসান মেহেদীর বাবা তার ছেলের স্মৃতি তুলে ধরে বলেন, আপনাদের মতো আমার ছেলেও সাংবাদিক ছিল। আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে পুলিশ। আমি যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যার বিচার চেয়ে মামলা করি, সেখান থেকে কোর্টে মামলা করেছি কিন্তু পুলিশ একজনকেও গ্রেপ্তার করেনি।
বিএফইউজের সাবেক সভাপতি ও সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আবদুল্লাহ বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এত কম সময়ে, এত জীবন দান পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। স্বৈরাচারের সময় প্রতি মাসে ২৫-৩০ জন করে সাংবাদিক নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার হয়েছেন।
সাংবাদিক নেতা ও কবি আব্দুল হাই শিকদার বলেন, সবার জন্য সব কিছু আছে বা হয়, কিন্তু সাংবাদিকদের জন্য কেউ কিছু করে না, করেনি। সাংবাদিকদের অন্য চোখে দেখত সরকার। কত সাংবাদিক নিহত ও খুন হয়েছে, সাগর-রুনি হত্যা মামলা নিয়ে কি করেছে সরকার- এটি একটি উদাহরণ। স্বাধীনতার পর মুজিবের ফ্যাসিজমের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার আত্মীয়রা ফুলেফেঁপে উঠছিল। কত লাঞ্ছনা-বঞ্চনার মধ্যে পড়েছিল এই জাতি, খাদ্যে ভরপুর থাকলে না খেয়ে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। অথচ কোনো সরকার সেই মুজিবের আমল নিয়ে কথা বলেনি।
সব জায়গায় গিজ গিজ করছে ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মারা এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত কঠিন হয়ে, প্রতি বিপ্লবের ষড়যন্ত্রকারীদের শক্ত হাতে দমন করা।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজের) সভাপতি শহীদুল ইসলাম বলেন, একটানা এক মাস ৫ দিনের আন্দোলনে স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। এই আন্দোলনে আবু সাঈদ ও মুগ্ধের পাশাপাশি শত শত শহীদের সঙ্গে আমাদের ৫ সাংবাদিক শহীদ হয়েছেন। সাংবাদিকরা আন্দোলন করতে যায়নি গিয়েছিলেন শুধু আন্দোলনের খবর সংগ্রহের জন্য। তারাও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। এই শহীদ সাংবাদিকদের পরিবারের জন্য কি আর করত পারব?
তিনি বলেন, তবে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কিছু নেই আমাদের কাছে। তবে একটি দাবি করছি, প্রত্যেক শহীদের নামে যারা যে এলাকায় শহীদ হয়েছেন তাদের নামে রাস্তা ও স্মৃতিফলক স্থাপন করতে হবে। যেন স্বৈরাচারের চিহ্ন হয়ে থাকে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে, একটি স্বৈরাচার কিভাবে টিকে ছিল জোর-জবরদস্তি করে। আর যেন কেউ স্বৈরাচার হওয়ার চেষ্টা না করে।
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন- জাতীয় প্রেসক্লাবের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ভুঁইয়া, সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলম, ডিআরইর সাবেক সভাপতি মুরসালিন নোমানী, ডিইউজের সহসভাপতি মোহাম্মদ বাছির জামাল প্রমুখ।
মন্তব্য করুন