বাসস
প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:১৬ পিএম
আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:১৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
বাসসের প্রতিবেদন

হৃদয়ের লাশ নিয়ে যায় পুলিশ, এখনও অপেক্ষা মায়ের

একমাত্র ছেলের লাশের অপেক্ষায় মা রেহানা বেগম। ছবি : সংগৃহীত
একমাত্র ছেলের লাশের অপেক্ষায় মা রেহানা বেগম। ছবি : সংগৃহীত

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিজয় মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন হৃদয় মিয়া। তিনি ছিলেন তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। ছেলের লাশ পুলিশ টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে, এমন ভিডিও দেখেছেন মা রেহেনা বেগম। কিন্তু দেড়মাস প্রায় হয়ে গেল, এখনও মেলেনি সন্তানের লাশ। পুত্র হারানোর শোক আর অভাবের তাড়নায় দিশেহারা মা রেহানা বেগম। তার কান্না আর আহাজারিতে বিদীর্ণ টাঙ্গাইলের মধ্যপাড়া গ্রাম।

ঘটনা গত ৫ আগস্টের। গাজীপুরের কোনাবাড়িতে পুলিশের টিয়ারশেল ও গুলি থেকে বাঁচতে হৃদয় একটি ভবনের পাশে গিয়ে লুকায়। কিন্তু বিধিবাম পুলিশ লুকায়িত অবস্থায় ছেলেটিকে দেখে ফেলে। পুলিশ লুকায়িত অবস্থায় হৃদয়কে ধরে ফেলে। হৃদয়ের আকুতি-মিনতি অগ্রাহ্য করে পুলিশ তাকে মারধর করে। একটি সময় পুলিশ সদস্যরা মারধর করে তৃপ্তি না পেলে হৃদয়কে চারপাশ দিয়ে ঘিরে রাখে। একজন পুলিশ সদস্য এসে হৃদয়কে গুলি করে। হৃদয়কে গুলি করার পরও তারা চারপাশে গুলি করতে থাকে। কিছু সময় পর কয়েকজন পুলিশ সদস্য মৃত হৃদয়ের লাশ নিয়ে চলে যায়। যেখানে তাকে হত্যা করা হয়েছে পাওয়া যায় নিহত হৃদয়ের রক্তাক্ত লুঙ্গি। নিহত হৃদয়কে আর পাওয়া যায়নি। কথা গুলো বলছিলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রবিন মিয়া।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রবিন মিয়া আরও বলেন, কোনাবাড়িতে আমরা বিজয় মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। মেট্রো থানার সামনেই আমরা অবস্থান নিয়েছিলাম। পুলিশ আমাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য টিয়ালশেল ও গুলি করে। তখন অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। পুলিশ হৃদয়কে গুলি করে হত্যা করে আমাদের চোখের সামনে। ভয়ে এগিয়ে যেতে পারিনি। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম হৃদয়ের মৃত্যু। ভেবেছিলাম পরিবেশ শান্ত হলে তার লাশ আনতে যাবো। পরে পুলিশ হৃদয়ের লাশ নিয়ে চলে যায়।

৫ আগস্ট ওইদিন ঘটনাস্থলের আশপাশের বাসা থেকে ধারণ করা কয়েকটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, ১০-১২ জন পুলিশ সদস্য এক যুবককে ধরে সড়কের ওপর নিয়ে লাঠিচার্জ করছে। এরপর তাকে চতুর্দিকে ঘিরে ফেলে মারধর করছে। এরমধ্যে হঠাৎ করেই একজন পুলিশ সদস্য সামনা-সামনি গুলি করে। এতে মুহুর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন হৃদয়। পরে পুলিশ সদস্যরা সেখান থেকে চলে যায়। এরপর আবার চারজন পুলিশ সদস্য দুইজন হাত, দুইজন পা ধরে তাকে নিয়ে যায়। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, তিনজন পুলিশ সদস্য তাকে টেনেহিঁচড়ে একটি গলির ভেতর নিয়ে যাচ্ছে। এ সময় আশপাশ থেকে প্রচণ্ড গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এরপর ওই তিনজন তার লাশ ফেলে চলে যায়। তার একটু পর আবার দুইজন এসে তার লাশ গলির ভেতর নিয়ে গেছে।

টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর ইউনিয়নের আলমনগর মধ্যপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক লাল মিয়া ও রেহেনা বেগম দম্পত্তির একমাত্র ছেলে সন্তান হৃদয় (২০)।

হৃদয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নিহত পুত্রের লাশের ভিডিও দেখেছেন মা। কিন্তু দেড়মাস প্রায় হয়ে গেল, এখনো মেলেনি সন্তানের লাশ। পুত্র হারানোর শোকে দিশাহারা মা রেহানা বেগম।

এদিকে বোন জামাইয়ের দেয়া একটি ঘরে বসবাস করে হৃদয়ের বাবা-মা। তার পাশে একটি জরাজীর্ণ ঘরে থাকতো হৃদয়। সেই ঘরেই হৃদয়ের জামা-কাপড় ও বিভিন্ন জিনিসপত্র রাখা। একমাত্র ছেলে হৃদয়কে হারিয়ে পাগল প্রায় মা। বাড়িতে রাখা ছেলের জামা-কাপড়, খেলাধুলায় পাওয়া বিভিন্ন পুরস্কার হাতে নিয়ে কাদঁছেন আর বিলাপ করছেন।

প্রতিবেশীদের সান্তনায় কান্না থামছে না রেহানা বেগমের। বাকরুদ্ধ পিতার দুই চোখে অঝোর অশ্রুধারা। শোকে পরিণত হয়েছে বাড়িটি। প্রতিদিনই ওই বাড়িতে গ্রামের লোকজন ভিড় করছেন পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে।

হৃদয়ের বোন জামাই ইব্রাহিম হোসেন বলেন, বিজয় মিছিলে গুলির ঘটনায় আমি কোনাবাড়ি থানাসংলগ্ন একটি বাসায় আশ্রয় নিই। ওই বাসার গেট থেকে দেখতে পাই চারজন পুলিশ সদস্য গুলিবিদ্ধ একজনকে চ্যাংদোলা করে থানার সামনে নিয়ে বেঞ্চের আড়ালে লুকিয়ে রাখেন। হৃদয়ের মতো দেখতে হলেও গুলির ভয়ে তখন কাছে যাওয়ার সাহস পাইনি। পরে ঘটনাস্থল থেকে তার পরনের লুঙ্গি পাওয়া গেলে নিশ্চিত হই যে নিহত যুবক হৃদয় এবং তার লাশ গুম করা হয়েছে। আমরা এর সঠিক বিচার চাই।

জানা যায় হৃদয় গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ডিগ্রি কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার দুইবোনের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। তার বাবা লাল মিয়া এলাকায় ভ্যান চালাতো। তবে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় কয়েকমাস ধরে তিনি আর ভ্যান চালাতে পারেন না। এই অবস্থায় নিজের পড়াশোনার খরচ ও সংসার চালানোর জন্য কাজের সন্ধানে প্রায় তিন-চার মাস আগে গাজীপুরের কোনাবাড়ি যান হৃদয়। পরে সেখানে একটি অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে চালাতেন।

হৃদয়ের বোন জিয়াসমিন আক্তার বলেন, হৃদয়ের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষে বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়ানো। পুলিশ হত্যা করেছে আমার ভাইয়ের স্বপ্নকে। আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার চাই।

হৃদয়ের মা রেহেনা বেগম বলেন, আমাদের ভালো রাখা ও পড়াশোনা করার জন্য হৃদয় কোনাবাড়িতে কাজ করতে গিয়েছিল। ১০ হাজার টাকা কিস্তি তুলে আমার বাবাকে দিয়েছিলাম গাড়ি চালানো শিখতে। আমার বাবা আর গাড়ি চালাবে না। সেই কিস্তির টাকা এখন কে দিবে। আমার বাবাটাকে মেরে ফেলেছে পুলিশ গুলি করে। আমার ছেলের লাশ ফেরত দিন। আমি দেখবো একটি বার।

হৃদয়ের বাবা লাল মিয়া বলেন, ঘটনার দিন তাকে বাড়িতে আসতে বলেছিলাম। কিন্তু ছেলে বললো, ভাইয়ের (বোন জামাই) সাথে যাব। আমরা ছেলে আর ফিরে নাই। আমার ছেলের লাশ ফেরত চাই।

আলমনগর ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার আব্দুল হামিদ বলেন, কোনাবাড়িতে আমার দোকান আছে। মিছিলের আগেই হৃদয় আমার দোকানের সামনে ছিল। সে সময় তার বোন জামাইও সঙ্গে ছিল। বোনের জামাই দূর থেকে দেখেছে কিভাবে হৃদয়কে গুলি করে মেরেছে পুলিশ। কিন্তু ভয়ে কেউ সামনে যাওয়ার সাহস পায়নি।

হৃদয়ের লাশ শিগগিরই তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর এবং হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তির দাবি জানান তিনি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ড. ইউনূসকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের

মাদারীপুরে কৃষককে পিটিয়ে হত্যায় মানববন্ধন

জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন গ্রিডের টাওয়ার পদ্মায় বিলীন

দীঘিনালায় দুপক্ষের সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ

তিন মাস ধরে ১৪শ চা শ্রমিকের মজুরি বন্ধ

নীতিমালার খসড়া অনুমোদন / সম্পদের হিসাব দিতে হবে উপদেষ্টাদেরও

জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন গ্রিডের টাওয়ার পদ্মায় বিলীন

বিটকয়েনে বার্গারের দাম পরিশোধ করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

ডেঙ্গুতে আরও ৩ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৭

চর দখলের মতো সাংবাদিক সংগঠনগুলো নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা চলছে : শওকত মাহমুদ

১০

নেতাকর্মীদের জরুরি নির্দেশনা দিল আ.লীগ

১১

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের নির্মাণসামগ্রী ও গবাদিপশু দিল বিএনপি

১২

ছেলে নিহতের চার ঘণ্টা পর মারা গেলেন বাবা

১৩

আন্দোলনে থাকা নেতাকর্মীদের পেছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক 

১৪

দেড় মাসেও হদিস মেলেনি বগুড়া থানার লুট হওয়া অস্ত্রের

১৫

চিহ্নিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দেশকে অকার্যকর করতে চায় : আহলে সুন্নাত

১৬

কুচক্রি মহল জাপা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দিয়েছে : চুন্নু

১৭

হেলিকপ্টারে চট্টগ্রামে নেওয়া হলো সাবেক এমপি ফজলে করিমকে

১৮

৫৬ জেলায় দাবদাহ, তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস

১৯

আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল

২০
X