রাজধানীর বিস্তৃত এলাকাজুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহে নিয়োজিত ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানিতে (ডেসকো) বছরের পর বছর ধরে চলছে দেদার লুটপাট। অবাস্তব প্রকল্প গ্রহণ, প্রকল্প ব্যয় কয়েক গুণ বৃদ্ধি, নিয়োগের ক্ষেত্রে চরম আত্মীয়করণ, দুর্বল ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে টাকা আত্মসাৎ, কেনাকাটায় অতিরিক্ত ব্যয়, অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণসহ এহেন কোনো অবৈধ কাজ নেই, যা এই প্রতিষ্ঠানে হয়নি।
ডেসকো পরিচালনার নীতিই যেন ‘যেমন খুশি তেমন খাও’। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এই লুটপাটে নেতৃত্ব দিচ্ছে কর্মকর্তাদের একটি সিন্ডিকেট। অনেকটা প্রকাশ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি হলেও সবসময়ই নীরব ছিল বিদ্যুৎ ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। কারণ দুর্নীতিবাজ চক্রের প্রতি সাবেক মন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর আশীর্বাদ ছিল।
জানা গেছে, অর্থ আত্মসাৎ করতে চতুরতার আশ্রয় নিয়েছেন ডেসকোর দুর্নীতিবাজরা। বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ওয়ার্কস ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরিধি এবং প্রজেক্টেড ভ্যালুও পরিবর্তন করে ৩৩০ কোটি টাকা নির্ধারিত হয়। এই কেনাকাটা থেকে অর্থ আত্মসাতে সুবিধার জন্য ‘ইনভাইটেশন অব ইন্টারন্যাশনাল টেন্ডার’ ক্রয় কার্যটির নাম পরিবর্তন করা হয়। পরে এর আলোকে দুটি স্টেশন বেজড ফুললি অটোমেটিক মিটার টেস্টিং বেঞ্চ ক্রয় করা হয়। ক্রয়কৃত টেস্টিং বেঞ্চ নিম্নমানের উল্লেখ করে ডেসকোর টেস্টিং অ্যান্ড রিপেয়ারিং ডিভিশন লিখিতভাবে জানায়। এ ছাড়া এসব টেস্টিং বেঞ্চের বাজার মূল্য ৮ কোটি টাকার কম হলেও ১৭ কোটি টাকায় কেনে ডেসকো। এসব কেনাকাটা করা হয় এসএস করপোরেশন নামে একটি অখ্যাত কোম্পানির মাধ্যমে।
এ ছাড়া একই প্রকল্পের আওতায় এডেক্স করপোরেশনের মাধ্যমে ২৫০ কেভিএ ৬৯০টি ডিস্ট্রিবিউশন ট্রান্সফরমার ক্রয় করা হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ২৬ কোটি টাকা। এখানেও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে ডেসকো। সংস্থাটির টেস্টিং অ্যান্ড রিপেয়ারিং ডিভিশনের প্রাপ্ত তথ্যে এখানে ২৫০ কেভি উল্লেখ করলেও ছিল ২০০ কেভির। তবে এমন জালিয়াতির আশ্রয় নিলেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলেও ডেসকোতে তার আঁচ লাগেনি। উল্টো দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা একাট্টা হয়ে আগের মতোই লুটপাটে সহায়ক প্রকল্প পাস করাতে উঠেপড়ে লেগেছেন। গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানে সক্রিয় দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে যে কোনো সময় বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকের।
জানা যায়, ডেসকোর প্রধান প্রকৌশলী ছাড়াও নির্বাহী পরিচালক (সংগ্রহ) এ কে এম মহিউদ্দিন, প্রধান প্রকৌশলী (ডেভেলপমেন্টস অ্যান্ড প্রজেক্টস) শরিফুল ইসলাম, প্রধান প্রকৌশলী (প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিজাইন) জুলফিকার তাহমিদ ও মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মামুনুর রশীদের নেতৃত্বে কেনাকাটা এবং লুটপাটের এ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। আর অনিয়ম পাকাপোক্ত করতে ডেসকো এবং মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের স্বজনদের চাকরি দেওয়া হয় ডেসকোতে।
সিন্ডিকেটের এমন ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতিতে বাড়ছে সিস্টেম লস, যা গড়ে বর্তমানে সাড়ে ৬ শতাংশের বেশি। একসময়ের লাভজনক প্রতিষ্ঠানটিতে বাড়ছে লোকসান। ২০১৪ সালে নসরুল হামিদ মন্ত্রী হওয়ার আগে ডেসকো বছরে আড়াইশ থেকে ৪০০ কোটি টাকার বেশি লাভ করত। এখন মাসে গড়ে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে।
তথ্য বলছে, নির্বিঘ্নে অর্থ আত্মসাতে যে কোনো প্রকল্প পাসের পর সিন্ডিকেটের পছন্দের ব্যক্তিকে প্রকল্প পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিজাইন দপ্তর থেকে এমনভাবে মেটেরিয়ালের স্পেসিফিকেশন তৈরি করা হয়, যাতে বিশেষ প্রতিষ্ঠান, ঠিকাদার কিংবা কোম্পানি ছাড়া অন্য কেউ কাজ না পায়। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই সাবেক বিদ্যুৎ মন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠানই কাজ পেয়ে আসছে ডেসকোতে।
জানা গেছে, ২০১২ সালে নেওয়া এসডিইডিএন অ্যান্ড ইউইডিএসজিসি প্রকল্পের ১১৫ কোটি টাকার অব্যবহৃত পণ্য ২০১৪ সালে রেভিনিউ খাতে স্থানান্তর করা হয়। এরপর পেরিয়ে গেছে ১০ বছর। কিন্তু সেই পণ্যগুলো এখনো ব্যবহার করা হয়নি।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান কালবেলাকে বলেন, ‘অনিয়ম সব জায়গায় হয়েছে। আপনারা লিখে যদি আমাদের নজরে আনতে পারেন, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব। যেসব অনিয়ম হয়ে গেছে, তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেব। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের অনিয়ম না হয়, সে বিষয়ে কঠোর তদারকি থাকবে।’
মন্তব্য করুন