সব রকম সেন্সরশিপ বাতিলের অঙ্গীকার করেছেন শিল্পকলা একাডেমির নতুন মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ। সেসঙ্গে নিজেকেও জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) বেলা ৩টায় জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নবনিযুক্ত মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ এর সাথে সাংবাদিকবৃন্দের মতবিনিময়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে নতুন মহাপরিচালক এ মন্তব্য করেন।
এসময় তিনি শিল্পকলা একাডেমি নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ ও প্রতিশ্রুতির কথা ১২টি শিরোনামে তুলে ধরেন। তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আইনের ফাঁক, সমাধানের রূপকল্প, কট্টরপন্থি বাঁধা, বৈশ্বিক সংযোগ বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক মুক্তি ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরেন।
এ ছাড়াও তিনি বর্তমান আইনের পর্যালোচনায় কয়েকটি দিক নির্দেশনা তুলে ধরেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন, ১৯৮৯-এর ধারা ২ থেকে ধারা ১৩-এর ৩নং উপধারা পর্যন্ত কোথাও বস্তুত এই একাডেমি বলতে রাষ্ট্র কী মনে করে এবং এর ভিশন (রূপকল্প) কী তা স্পষ্ট হয় না। এই আইনের ৪নং ধারা অনুযায়ী, ‘একাডেমির সাধারণ পরিচালনা ও প্রশাসন একটি পরিষদের ওপর ন্যস্ত থাকিবে এবং পরিষদ সেই সকল ক্ষমতা প্রয়োগ ও কাজ করিতে পারিবে যাহা একাডেমি কর্তৃক প্রযুক্ত ও সম্পন্ন হইতে পারে।’
তিনি বলেন, কিন্তু সাধারণ পরিষদ গঠনের বিধি সংবলিত ৫নং ধারায় বর্ণিত ১৩টি উপধারা পর্যালোচনা করে প্রতীয়মান হয় যে, একাডেমি যেন সরকারের আজ্ঞাবহ একটি দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত ও পর্যবসিত হবার ঝুঁকিতে পতিত হয়েছে।
অথচ ৩নং ধারার ২নং উপধারায় বলা হয়েছে, ‘একাডেমি একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হইবে।’
একাডেমির ক্ষমতা ও দায়িত্বসংক্রান্ত ৭নং ধারায় বর্ণিত ১৫টি উপধারাগুলোর অস্পষ্টতা, সীমাবদ্ধতা ও অপপ্রয়োগে বিগত সকল শাসনামলেই লক্ষ্য করা গেছে। ফলে, পদলেহী শিল্পীদের দ্বারা সরকারি শিল্পকর্ম যাচ্ছেতাইভাবে সৃষ্টি করে একাডেমি একটি অনুগত ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
রূপকল্পে তিনি বলেন, অতএব, ২০২৪-এর রক্তস্নাত জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-উত্তর এই সময়কে একদিকে সম্ভাবনাময়, অন্যদিকে এক ক্রান্তিক্ষণ রূপে বিবেচনা করা যায়। একাডেমির ভিশনকে পুনরায় নির্ণয় করার প্রয়োজনীয়তা এখন এই নতুন সময়ের নতুন দাবিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি হবে বিবিধ সংস্কৃতির হাজার মালভূমি দিয়ে গঠিত সৃষ্টি-কৃষ্টির এক যৌথ জমিন। এক জাতি, এক রাষ্ট্র, এক নেতা, এক ভাষা, এক ধর্ম ও এক মতাদর্শভিত্তিক সাংস্কৃতিক চর্চাকে একাডেমি সর্বদা ‘না’ বলবে। বরং, বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু ভাবাদর্শভিত্তিক সৃষ্টি-সৌন্দর্য-আনন্দের এক সংলাপাত্মক জনগণতান্ত্রিক শিল্প-পরিসর রূপে গড়ে উঠবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। দেশজ সংস্কৃতি ও বিশ্ব-সংস্কৃতির যোগসাধন করে একাডেমি এক নতুন দিনের সাংস্কৃতিক অনুশীলনের সেতুবন্ধন ঘটাবে।
এছাড়াও তিনি বলেন, বাংলাদেশে ইসলাম প্রশ্নে যুক্ত হয়ে দৃঢ়ভাবে বলা যায় যে ইসলামের সঙ্গে সাংস্কৃতিক চর্চার কোনো বিরোধ নেই। সেই বিরোধিতার দর্শন ও বাস্তবতার জ্ঞান নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আরও সবল বেগে পরিচালিত হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক একাডেমিতে পরিণত করতে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে একে একটি কার্যকর বহুত্ববোধক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। বাজেট বৃদ্ধি ও এর নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের রূপান্তরেও কেবল ‘ইনফ্রাসট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট’ নয় বরং ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট’ ধারণাকে একটি অন্যতম নীতিরূপে গণ্য করতে হবে। এই নীতি অনুযায়ী সংস্কৃতি খাতে জিডিপির কমপক্ষে তিন শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে আর্থিকভাবে সক্ষম ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার প্রয়োজন স্বীকার করে প্রযোজ্য সমর্থন ও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
একাডেমির বিকেন্দ্রীকরণে তিনি বলেন, একাডেমির বাজেট বাড়িয়ে জেলা ইউনিটগুলোকে স্থানীয় সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসিত এককে পরিণত করতে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয় বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিগুলোর প্রদর্শন, পুনঃসৃজন ও উদ্ভাবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। কারণ, লোকজ শিল্পী ও জনগণের পরিসর রূপে জেলা শিল্পকলা একাডেমিগুলোকে গড়ে তোলার আর কোনও বিকল্প নেই।
রাষ্ট্র, সরকার ও একাডেমির ত্রিমুখী সম্পর্কে তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সরকারি যথেচ্ছাচারমূলক ইচ্ছা পূরণের তল্পিবাহক প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত হবার দুষ্টচক্র থেকে শিল্পকলা একাডেমিকে বের করে আনা এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে গঠিত জনগণের সাংস্কৃতিক ইচ্ছাকে উপলব্ধি করে একাডেমিকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে প্রয়োজন সর্বাত্মক জরুরি তৎপরতা। এর মহাপরিচালককে সাংস্কৃতিক উপদেষ্টার নিকট দায়বদ্ধ থাকতে হবে ও জবাবদিহি প্রদান করতে হবে।
রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিশ্বসমাজের যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার সাংস্কৃতিক চিন্তা অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়কে শুধু একরৈখিকভাবে কল্পনা করা যাবে না। দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে অপরাপর বৈশ্বিক সংস্কৃতির সংলাপ ও সংশ্লেষ ঘটাতে হবে।
দুর্নীতিমুক্ত একাডেমি গঠন জোর দেন তিনি। তিনি দুর্নীতির অসৎ প্রক্রিয়া অনুসন্ধান, দুর্নীতির কারণ চিহ্নিতকরণ ও নিশ্চিহ্নকরণে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রতি জোর দেন। সেই লক্ষ্যে একজন ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইজার স্বল্পকালীন সময়ে নিয়োজিত করে আর্থিক দুর্নীতির খাত ও কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে। সেই মোতাবেক আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করেই কেবল একাডেমির নতুন অভিযাত্রা সূচনা করা সম্ভব।
এ নিয়ে আশু করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২১টি জেলার শিল্পকলা একাডেমি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেগুলো সচল ও পুনর্গঠনের লক্ষ্যে মহাপরিচালকের জরুরি পরিদর্শন ও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন হবে।
এই কাজে, সর্বক্ষেত্রে, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের সংযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ। এই যোগসাধনে কী করণীয় তা সর্বাগ্রে নির্ধারণ করতে হবে। কেন্দ্রীয় শাখায় কনজারভেটরি স্থাপন করে বহুমুখী শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ-সৃজন কর্ম দ্রুত সূচনা করে জনগণের আস্থা ফেরাতে হবে।
স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে করণীয়তে তিনি বলেন, এই তিন কাল পর্বে, একাডেমিকে নতুন দেশের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সচল করতে বস্তুত দরকার হলো সংস্কার ও গণতান্ত্রিক রূপান্তর। এই লক্ষ্য পূরণে মহাপরিচালকের দায়-দায়িত্ব, ক্ষমতা-পদসোপান ও জবাবদিহি অবশ্যই পুনর্নির্ধারণ করতে হবে।
মন্তব্য করুন