সুপারশপে পলিথিন ও পলিপ্রপিলিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
সোমবার (০৯ সেপ্টেম্বর) মন্ত্রণালয়টির জনসংযোগ কর্মকর্তা দীপংকর বর স্বাক্ষরিতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে কোনো পলিথিন শপিং ব্যাগ ও পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ রাখা যাবে না এবং ক্রেতাদের দেওয়া যাবে না। বিকল্প হিসেবে সকল সুপারশপে বা এর সম্মুখে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের ক্রয়ের জন্য রাখা হবে। এখানে তরুণ/ শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা হবে।
১৫ সেপ্টেম্বর থেকে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে ১ অক্টোবর এর শপিং ব্যাগের ব্যান এর বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার হবে এবং পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে বলেও জানান তিনি।
সোমবার বাংলাদেশ সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে পলিথিন শপিং ব্যাগের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে স্টেকহোল্ডারদের সাথে অনুষ্ঠিত সভায় তার বক্তব্যে পরিবেশ উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।
পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এক সপ্তাহের মধ্যে সকল সুপারশপের সাথে সভাকরে পাটের শপিং ব্যাগ এর সরবরাহ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পরিবেশ অধিদপ্তর ESDO এর সাথে মিলে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিকল্প পরিবেশবান্ধব উপাদানে তৈরি / পাট/ বস্ত্রের ব্যাগের উৎপাদনকারীদের নিয়ে একটি মেলার আয়োজন করবে। মেলায় সুপার শপের কর্তৃপক্ষ এবং উৎপাদনকারীরা নিজেদের চাহিদা এবং সরবরাহর বিষয়ে আলোচনা করতে পারবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিববৃন্দ, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, অন্যান্য মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন সুপার শপের প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
উল্লেখ্য, পলিমারকরণ বিক্রিয়ায় ইথিন থেকে প্রাপ্ত পলিমারকে পলিথিন বলে। বিজ্ঞানী হান্স ফন পেখমান ১৮৯৮ সালে গবেষণাকালে দুর্ঘটনাক্রমে এ পলিথিন আবিষ্কার করেন বলে জানা যায়। তারপর বিভিন্নভাবে রিফাইন করে ১৯৪৪ সালে বাণিজ্যিকভাবে এ পলিথিনের ব্যবহার শুরু হয়। সেই থেকে পৃথিবীর মাটি, বায়ু, পানি বিষাক্ত হওয়া শুরু। কারণ পলিথিন দীর্ঘস্থায়ী, ক্ষয় নাই বরং ভেঙে গিয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক নামের ক্ষুদ্রাংশে পরিণত হয়, এ মাইক্রোপ্লাস্টিক বাতাসের সঙ্গে মিশে শ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, পলিথিন ব্যাগ অবাধ ব্যবহারের ফলে চর্মরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্নায়ুজনিত রোগ, ক্যান্সার, কিডনি ড্যামেজসহ জটিল রোগে ভুগছে মানবজাতি। পাশাপাশি প্লাস্টিক উৎপাদনের কাঁচামাল ইথিলিন ও প্রোপিলিন পেতে জীবাশ্ম জ্বালানি (প্রায় ৯৯ শতাংশ প্লাস্টিক আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে), অপরিশোধিত তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস নিষ্কাশনের প্রয়োজন হয়। এই নিষ্কাশন প্রক্রিয়ার ফলে মাটি, বায়ু ও পানি মারাত্মকভাবে দূষণ হচ্ছে (তথ্য : আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইন কেন্দ্র), ফলে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে মানুষ, পশুপাখি, জলজ প্রাণীসহ জীববৈচিত্র্যের ওপর। পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়।
জাতিসংঘের পরিবেশ প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতি বছর সমুদ্রে প্রবেশ করে। অন্যদিকে প্লাস্টিক বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলার ফলে কার্বন মনোঅক্সাইড গ্যাস বাতাসে মিশে বায়ুদূষণ ঘটছে। পলিথিনের ভয়াবহ কালো থাবা থেকে বাদ পড়েনি বাংলাদেশ, ১৯৮২ সালে সবুজে ঘেরা এ দেশটিতে পলিথিনের যাত্রা শুরু, তারপর থেকে প্রতিনিয়ত উচ্ছিষ্ট পলিথিন প্যাকেট, প্লাস্টিকের তৈরি পানি ও ড্রিঙ্কসের বোতল, কনটেইনার ইত্যাদি ডোবা-নালা, খাল-বিল, হ্রদ ও নদীর তলদেশে জমা হচ্ছে। শুধু ঢাকায় ১০০ কোটি পলিথিন ব্যাগ ভূপৃষ্ঠের নিচে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে (ঢাকা ওয়াসা, ২০২০), ফলে ভূগর্ভস্থ পানি ও অক্সিজেন প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে, জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে, ভূমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে; ফলে উদ্ভিদের উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস বলে, আশির দশক পর্যন্ত এ পাট রপ্তানি করে বাংলাদেশ জিডিপির সিংহভাগ অর্জন করেছে। এ দেশের অর্থনীতিতে স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিল পাটশিল্প।
আরও একটু পেছনে ফিরে তাকাই, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের পরও আমরা দেখেছি হাটবাজারে চটের ব্যাগের প্রচলন। আমাদের বাবা-চাচারা চটের তৈরি ব্যাগে বাজার-সদাই করতেন। শুকনা খাদ্যদ্রব্য কাগজের প্যাকেট বা মোড়কে দেওয়া হতো। অধিকাংশ বাড়িতে পাট দিয়ে তৈরি পাপোশ, ম্যাট, মোড়া, দোলনা, শিকাসহ নানান শৌখিন দ্রব্যসামগ্রী, যা কি না দেশজ কুটিরশিল্প বাঁচিয়ে রেখেছিল এবং পরিবেশবান্ধব। সেই উজ্জ্বল সম্ভাবনার সোনালি আঁশ ছাপিয়ে মহামারি আকারে পলিথিনের প্রচলন এ দেশের কৃষকের আয়ের পথ বন্ধ করে দিল, দেশের বৃহত্তম পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে গেল, ফলে প্রায় তিন দশক ধরে বাংলাদেশে রপ্তানি আয়ের ধস নামল।
মন্তব্য করুন