দেশে এক সপ্তাহ ধরে যে ভয়াবহ বন্যা চলছে, তাতে ১১ জেলায় ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৭ লাখ ১ হাজার ২০৪ জনে। বন্যার মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে, তা কমে যাওয়ার আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
গত ২৪ ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলার ভারতীয় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরার অববাহিকাগুলোয় উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়নি। এ অবস্থায় ফেনী ও কুমিল্লা জেলার নিম্নাঞ্চলের বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নতুন নতুন এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে। নড়াইলে ঘরবাড়ি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সড়কের কোথাও কোথাও হাঁটুসমান পানি জমেছে। টানা বৃষ্টিতে খুলনায় জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, বাগেরহাট শহরের বেশিরভাগ এলাকা ও প্রধান প্রধান সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। বৃষ্টিপাত থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মৌলভীবাজার ও খাগড়াছড়ির বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হতে শুরু করেছে। উজানের তীব্র ঢল এবং অতিভারি বৃষ্টির কারণে গত মঙ্গলবার থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। অল্প সময়ের মধ্যে তা বিস্তৃত হয় ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুল হাসান সোমবার (২৬ আগস্ট) সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানান, ১১ জেলায় ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৮টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যায় মৃত ২৩ জনের মধ্যে কুমিল্লায় মারা গেছে ছয়জন, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে মারা গেছে পাঁচজন করে এবং কক্সবাজারে তিনজন মারা গেছে। আর একজন করে মারা গেছে ফেনী, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লক্ষ্মীপুরে।
কামরুল হাসান বলেন, পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তিন হাজার ৮৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৫২৩ জন মানুষ এবং ২৮ হাজার ৯০৭টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য মোট ৬৪৫টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।
কামরুল হাসান বলেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে সহায়তা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে সচিব কামরুল হাসান বলেন, যারা ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে সহায়তা (চেক/পে-অর্ডার/ব্যাংক ড্রাফটের মাধ্যমে) দিতে চান তারা প্রধান উপদেষ্টার পক্ষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছেও তা দিতে পারেন।
এদিকে গত ১৬ আগস্ট থেকে আবহাওয়া অধিদপ্তর নিয়মিত ভারি বৃষ্টির সতর্কতা জারি করে আসছিল। সবশেষ শনিবার সন্ধ্যায় খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগ দুই দিনের ভারি বৃষ্টির সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল। রোববার বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ তৈরি হলেও সেটি বাংলাদেশের ওপর বিরাজ করছে না। তবে এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্রবন্দরগুলোর ওপর দিয়ে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় দেশের চার সমুদ্রবন্দরে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে এক সতর্কবার্তায়। সেখানে উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
নোয়াখালী ব্যুরো জানান, প্রবল বর্ষণ ও উজানের ঢলে নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নতুন নতুন এলাকায় ঢুকছে পানি। জেলার প্রায় ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে এ পর্যন্ত পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গতকাল সোমবার জেলা বন্যা কন্ট্রোল রুম থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। অন্যদিকে কোম্পানীগঞ্জের মুছাপুর রেগুলেটর ধসে যাওয়ায় এলাকায় চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, নোয়াখালীতে গত কয়েক দিনের ভয়াবহ বন্যায় জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে ৮ উপজেলা আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৮৭ ইউনিয়ন ও ৭ পৌরসভার ১৯ লাখ ৮১ হাজার ৭০০ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। জেলায় এক হাজার ৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলে ১ লাখ ৮২ হাজার ৩০৯ জনকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন এনজিও ব্যক্তিবিশেষ ও ছাত্র সমন্বয়করা আশ্রয়কেন্দ্রে খাওয়া পাঠাচ্ছেন। এ পর্যন্ত সরকারিভাবে ৪৫ লাখ টাকা, ৮৮২ মেট্রিক টন চাল ও এক হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এখনো ৯১৮ মেট্রিক টন চাল মজুত রয়েছে। ৮৮টি মেডিকেল টিম বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করছেন।
জেলা আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম কালবেলা জানান, সোমবার সকাল ১২টা পর্যন্ত বিগত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ১০৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এতে বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এতে ২০ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট। এদিকে বন্যায় বেড়েছে সাপের উপদ্রব। গত তিন দিনে নোয়াখালীতে ৬৩ জনকে সাপে কেটেছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে সাপে কেটেছে ২৮ জনকে। বন্যার কারণে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে ১০৮ জন।
নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) সৈয়দ মহিউদ্দিন আব্দুল আজিম কালবেলাকে বলেন, মেডিকেল টিম ছাড়াও হাসপাতালে সার্বিক চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রাখা হয়েছে। চিকিৎসকরা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন।
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, কেবলই অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে লক্ষ্মীপুরের বন্যা পরিস্থিতি। গতকাল সোমবার পানির উচ্চতা আরও বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে, যা গত রোববার আরও কম ছিল। ফলে চরম সংকট পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে জেলাজুড়ে। পানির উচ্চতা না কমলে মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৯০ শতাংশ এলাকাই এখন পানির নিচে। এতে ৭ লাখ ৪৭ হাজার ৪২০ জন লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এদিকে পানিবন্দি লোকজন ছুটে চলছেন আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে। কোনো কোনো আশ্রয়কেন্দ্র পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। নতুন করে লোকজনের ঘরেও পানি ওঠা শুরু হয়েছে। তারাও আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, শনিবার রাত থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত টানা বৃষ্টিপাত হয়েছে। আর নোয়াখালী থেকে রহমতখালী খাল, ভুলুয়া খাল ও ওয়াপদা খাল হয়ে ব্যাপকভাবে পানি ঢুকতেও দেখা গেছে। এতে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে। তবে পানিবন্দি অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে আত্মীয়ের বাড়িতেও আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে। জেলার বিভিন্ন এলাকার পানিবন্দিসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুর্গম এলাকাগুলোতে পানিবন্দিদের জন্য কোনো খাবার যাচ্ছে না। এজন্য ফেসবুকসহ নানাভাবে ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে মানুষ। দুর্গম এলাকায় ত্রাণ পৌঁছাতে পর্যাপ্ত নৌকার প্রয়োজন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জেপি দেওয়ান বলেন, জেলার বর্তমানে ৭ লাখ ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। আশ্রয়ণ কেন্দ্রে ২৩ হাজার ৪০৪ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। এখন পর্যন্ত ৯ হাজার ৯৪৩ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খিচুড়ি রান্না করে পরিবেশন করা হচ্ছে।
কুমিল্লা ব্যুরো জানান, স্মরণকালের ভয়াবহ আকস্মিক বন্যায় ডুবেছে কুমিল্লার অধিকাংশ এলাকা। বেশ কয়েকদিনের টানা ভারি বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ভয়াবহ এই বন্যার কবলে পড়েছে কুমিল্লাবাসী। গতকাল সোমবার দুপুর ২টা পর্যন্ত থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে জেলার প্রায় অধিকাংশ উপজেলাগুলোয়। এর আগে গত রোববার রাত থেকে এ বৃষ্টি শুরু হয়। এদিকে আবহাওয়া অফিস সূত্র থেকে জানা গেছে, মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তা ও আকাশে মেঘের কারণে এই বৃষ্টি। তবে যে পরিমাণ বৃষ্টি পড়ছে সেটি মিটার স্কেলের হিসাবে যোগ্য নয়। এ বৃষ্টির সঙ্গে মাঝারি আকারের ঠান্ডা বাতাসও প্রবাহিত হচ্ছে। কুমিল্লা আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ আরিফুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত এই বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে বলেও তিনি জানান।
অপরদিকে, জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ১৪টির অধিকাংশ এলাকা বন্যার পানিতে আবদ্ধ। উজানের পানি আসা বন্ধ না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বসতভিটা থাকার অযোগ্য হয়ে পড়ছে বেশিরভাগের। আবার অনেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠছেন।
এ পর্যন্ত কুমিল্লা জেলায় বন্যার পানিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। বুড়িচং উপজেলায় মসজিদ এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ের কিছু বহুতল ভবন ছাড়া সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত মোট ৩৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৩০ হাজারের অধিক মানুষ রয়েছে। এ ছাড়া নিজ বাড়ির বসতভিটায় পানিবন্দি অবস্থায় আছে ২ লাখের বেশি মানুষ। এ উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় বন্যায় পানি আটকে আছে। উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে গোমতীর উলটোপাড়ের ৩টি ইউনিয়ন ছাড়া বাকি ৬টিতে মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। তবে পর্যাপ্ত নৌকার অভাবে এসব ইউনিয়নের দুর্গম এলাকা পানিবন্দি মানুষের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন থানা ওসি মো. আবুল হাসানাত খন্দকার।
চকরিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে শত শত কৃষকের মাথায় পড়েছে হাত। এতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা পড়েছেন বেকায়দায়। অবিরাম বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট বন্যায় উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৪ হাজার ১০০ কৃষক। এতে প্রায় সাত কোটি টাকার মতো কৃষকের ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এসএম নাসিম হোসেন। কয়েকদিন ধরে গ্রামীণ জনপদ থেকে বানের পানি নামতে শুরু করেছে। এতে রাস্তাঘাট ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র দেখা যাচ্ছে। বন্যায় গ্রামীণ জনপদের পাশাপাশি ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে কৃষি অফিস জানায়, চকরিয়ার একটি পৌরসভাসহ ১৮টি ইউনিয়নের কৃষক রয়েছেন ৪ হাজার ১০০ জন। চলতি মৌসুমে ১০ হাজার ১০০ হেক্টর আমন ফসল আবাদ হয়েছে। বন্যায় আমনের আংশিক ক্ষতি ১৩০০ হেক্টর আর সম্পূর্ণ ক্ষতি ২২৩ হেক্টর। আমনের বীজতলা ১৩৯ হেক্টর আংশিক ক্ষতি, সম্পূর্ণ ক্ষতি হয়েছে ৮৩ হেক্টর। এদিকে আউশ ধানের আংশিক ক্ষতি ৪০০ হেক্টর, ৮২ হেক্টর সম্পূর্ণ ক্ষতি। শাকসবজি ২৬৯ হেক্টর ও ১৯ হেক্টর সম্পূর্ণ ক্ষতি হয়েছে। এতে সব মিলিয়ে প্রায় ৭ কোটি টাকার মতো কৃষকের ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বর্ষার শেষ সময়ে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে জমিতে চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন স্থানীয় কৃষকরা।
জানা গেছে উপজেলায় ১৯ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি চাষের আওতায় রয়েছে। চলতি মৌসুমে উপজেলায় ১০ হাজার ১০০ হেক্টরের অধিক জমি চাষের আওতায় এসেছে। পানিতে নিমজ্জিত হয়ে নষ্ট হয় অর্ধেকের চেয়েও বেশি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এসএম নাসিম হোসেন জানান, এ বছর আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ১৯ হাজার ৫০০ হেক্টর। তবে ১০ হাজার ১০০ হেক্টর জমি চাষের আওতায় রয়েছে। বন্যার পানি নেমে গেলে আরও আবাদ হবে। দ্রুত কৃষকদের প্রণোদনা শাকসবজি, আমনের বীজ ও আগাম সবজির বীজের সহায়তা দেওয়া হলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, বৃষ্টিপাত থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাগড়াছড়ির বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হতে শুরু করেছে। স্বস্তি ফিরেছে জনজীবনে। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষ বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। পানি নেমে যাওয়ার পরও ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি খাগড়াছড়ি জেলার ক্ষতিগ্রস্তরা। কী করবেন তা নিয়ে দিশেহারা।
টানা বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে রাস্তা ও সেতুর ক্ষতি হয়েছে। কৃষি খাতে ২ হাজার ১২৪ হেক্টর ফসলি জমির আমন, আউশ ও শাকসবজি নষ্ট হয়েছে। তবে কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আগাম রবিশস্য চাষে প্রণোদনা দেওয়ার কথা জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
এদিকে চেঙ্গী, মাইনী ও ফেনী নদীর পানি কমায় খাগড়াছড়ি জেলা সদর, দীঘিনালা, পানছড়ি, রামগড় ও মহালছড়িতে নদীর তীরবর্তী বসতবাড়ি ও কৃষি জমি ছাড়া অন্যান্য জায়গা থেকে পানি নেমে গেছে। পানি নামার পরও জেলার দীঘিনালা ও রামগড় উপজেলার অধিকাংশ কৃষি জমি এখনো পানির নিচে। চলতি বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দীঘিনালা। মাইনী নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠায় এটি মাইনী ভ্যালি হিসেবে পরিচিত উপজেলার মেরুং ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নটি পাঁচ থেকে ছয় দিন ধরে বন্যার পানি নিচে। কিছু কিছু গ্রামে ঘরবাড়ি থেকে পানি নেমে গেলে ফসলি জমি থেকে পানি নামেনি। ফলে এখানকার কৃষি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মেরুং ইউনিয়নে শতশত একর ফসলি জমি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
দীঘিনালার উপজেলা কৃষি অফিসার মো. শাহাদাৎ হোসেন জানান, বন্যায় আমনের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। বন্যার পানিতে ৭৬৫ হেক্টর জমির আমন চারা নষ্ট হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১ হাজার ৩২৩ জন কৃষক। এ ছাড়া ৯০ হেক্টর আউশ এবং ১৩৯ হেক্টর জমির সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। এতে প্রায় ৮০০ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
নড়াইল প্রতিনিধি জানান, নড়াইলে কয়েকদিন থেমে থেমে হালকা বৃষ্টির পর রোববার রাতভর ভারি বৃষ্টি হয়েছে। এতে জেলা শহরের অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ঘরবাড়ি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সড়কের কোথাও কোথাও হাঁটুসমান পানি জমেছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। গতকাল সোমবার সকালে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ভওয়াখালি, আলাদাতপুর, ভাদুলিডাঙ্গা, মহিষখোলাসহ পৌরসভার অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বাড়ির উঠান, টিউবওয়েল, রান্নাঘরে পানি ঢুকে গেছে। বেশ কয়েকটি সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সড়কে মশারি দিয়ে অনেককে মাছ ধরতেও দেখা গেছে।
এ ব্যাপারে পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা ওহাবুল আলম বলেন, স্থায়ী সমাধানের জন্য শহরে প্রয়োজন প্রায় ৫৫ কিলোমিটার নালা নির্মাণের। যার জন্য বড় ফান্ড প্রয়োজন। ফান্ডিংয়ের ব্যবস্থা করা গেলে নির্মাণের মাধ্যমে এ সমস্যার অনেকটা সমাধান করা সম্ভব।
খুলনা ব্যুরো জানায়, খুলনায় টানা বৃষ্টিতে জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গত রোববার দুপুরের পর থেকে ভারি বৃষ্টি হয়েছে। সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অবিরাম গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়। গত রোববার ভারি বর্ষণে ডুবে যাওয়া স্থানগুলো থেকে আজ (সোমবার) পানি সরলেও এখনো নগরের বেশ কিছু স্থান ও সড়ক প্লাবিত হয়ে আছে। বেশ কিছু সড়কে সংস্কারকাজ চলমান থাকায় কাদাপানির কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
জন্মাষ্টমী উপলক্ষে সোমবার ছুটির দিনে খুলনায় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া লোকজন কম বের হয়েছেন। সেইসঙ্গে ভোর থেকে বৃষ্টিতে নগরজুড়ে স্থবিরতা নেমে আসে। কাজে যেতে না পেরে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ বিপাকে পড়েন।
খুলনা আবহাওয়া কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত রোববার সকাল থেকে গতকাল সোমবার সকাল পর্যন্ত খুলনায় ৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। সকাল ৬টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত আরও ২০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। খুলনা আবহাওয়া কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ বলেন, আজ মঙ্গলবার থেকে বৃষ্টি কমে যাবে। আবার তিন-চার দিন পর বৃষ্টি শুরু হবে। এভাবে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলবে।
খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় গত ছয় বছরে ১০৪টি ড্রেন পুনর্নির্মাণ করেছে। ময়ূর নদসহ সাতটি খাল পুনঃখনন এবং ৩২টি ড্রেনের সংস্কার চলছে।
বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, ভারি বর্ষণে বাগেরহাট শহরের বেশিরভাগ এলাকা ও প্রধান প্রধান সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ওইসব এলাকার মানুষ। জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন শহরবাসী। শনিবার রাত থেকে রোববার সকাল ১০টা পর্যন্ত মুষলধারে বৃষ্টিতে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। শহরের পাশাপাশি জেলার নিম্নাঞ্চলও পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। বৃষ্টির পানি নামতে না পারায় ভোগান্তিতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অনেক মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৃষ্টির পানিতে বাগেরহাট সদর, রামপাল, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, মোংলা, কচুয়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিতে অনেকের পুকুর ও মাছের ঘের তলিয়ে গেছে।
পথচারী হাবিবা খাতুন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ড্রেন পরিষ্কার না করায় বৃষ্টির জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। হাঁটুসমান ময়লা পানির মধ্যেই চলাচল করতে হচ্ছে। আমরা দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান চাই।
জলাবদ্ধতার বিষয়ে কথা বলার জন্য পৌরসভার মেয়রসহ দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে মাসখানেক আগে পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী রেজাউল করিম রিজভি বলেছিলেন, শহরে পাঁচ কিলোমিটার ড্রেনের কাজ চলমান। ড্রেনের কাজ শেষে পাঁচটি খাল খনন কাজ শুরু করা হবে। খালের কাজ শেষ হলে পৌরবাসী জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে। এদিকে তিন দিন ধরে জোয়ারের পানিতে দিনে দুবার প্লাবিত হচ্ছে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। তবে এতে বন্যপ্রাণীদের কোনো ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের করমজল পর্যটন ও বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির।
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানান, মৌলভীবাজারে প্রধান তিন নদনদীর পানি বিপৎসীমার নিচে নেমে নামতে শুরু করায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হতে শুরু করেছে। সোমবার সকালে জেলার প্রধান নদনদীর মধ্যে মনু ও ধলাই নদ এবং কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে জুড়ী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মৌলভীবাজার কার্যালয় ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
পাউবো মৌলভীবাজারের বন্যা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র জানিয়েছে, সকাল ৯টায় মনু নদের পানি রেলওয়ে ব্রিজের কাছে বিপৎসীমার ২৭৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং মৌলভীবাজার শহরের কাছে চাঁদনীঘাটে বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। একইভাবে কুশিয়ারা নদীর পানি শেরপুরে বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ধলাই নদের পানি রেলওয়ে সেতুর কাছে প্রবাহিত হচ্ছিল বিপৎসীমার ৩৩০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে। শুধু জুড়ী নদীর পানি ভবানীপুর এলাকায় ১৫৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
জেলার মনু ও ধলাই নদ, সম্প্রতি জেলার মনু ও ধলাই নদ এবং জুড়ী ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমা ছাড়িয়েছিল। বিভিন্ন স্থানে ধলাই নদের বাঁধ ভেঙে জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। অন্যদিকে মনু নদের সেকেন্ডারি বাঁধ (মনু নদসংলগ্ন পাড়) ভেঙে কুলাউড়া এবং মনু নদের সেকেন্ডারি বাঁধ ও মনু নদ প্রকল্পের বাঁধ ভেঙে রাজনগরের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলে জানায় পাউবো।
পাউবো মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল বলেন, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আমি কুলাউড়া, রাজনগর, কমলগঞ্জসহ কয়েকটি জায়গা ঘুরে দেখেছি। পানি অনেকটা নেমে গেছে। তিনটি নদনদীর পানি বিপৎসীমার নিচে চলে এসেছে।
মন্তব্য করুন