আয়নাঘর সম্পর্কে পরিপূর্ণ তথ্য প্রকাশের দাবি জানিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। আয়নাঘর নামক গোপন নির্যাতন সেলের অবস্থান? কারা এই সেল পরিচালনা করত, তৈরি হওয়ার পর সর্বমোট কতজন এ আয়নাঘরে অন্তরীণ ছিল, তাদের পরিচয়, কোন আইন বলে তাদের অন্তরীণ করা হয় এবং কারা এই গোপন সেল তৈরির নেপথ্যে ছিল।
বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত সুয়োমোটোয় উল্লেখ করা হয়, গত দেড় দশক ধরে গুম করা ব্যক্তিদের ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত বন্দিশালায় অমানবিক অবস্থায় রাখা হতো।
একটি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তা জনসমক্ষে আসা উচিত। সেই সাথে আরও কোনো ব্যক্তি এই নির্যাতন সেলে আটক থাকলে দ্রুত মুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণসহ আয়নাঘর তৈরির নেপথ্যের কারিগরদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে কমিশনে দ্রুত প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবকে জানিয়েছে।
আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদনের জন্য ধার্য করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
আয়নাঘর থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিরা এখন নির্মমতার বর্ণনা দিচ্ছেন। ভুক্তভোগীদের বর্ণনা একত্রিত করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এর মধ্যে অনেকগুলো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তর (ডিজিএফআই) পরিচালিত ছিল।
এ জায়গাগুলো বাইরের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এখানে বন্দিরা বাইরের কোনো আলো দেখতে পান না। বিগত সরকারের শাসনামলে আয়নাঘরে দিন, মাস, এমনকি বছরের পর বছর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন সহ্য করেছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামভিত্তিক ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা তাদের একজন। ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে পাঁচ বছর বন্দি ছিলেন তিনি। গণঅভ্যুত্থানের মুখে হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মাত্র দুদিন পর মাইকেল মুক্তি পান। ভিয়েতনামে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন। প্রায় ১৬ মাস (৪৬৭ দিন) পর ২০১৯ সালের মার্চে বাড়ি ফেরেন।
তিনি জানান, অপহরণকারীরা কীভাবে তাকে সরকারবিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছিল। তার বিবরণে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, অপহরণকারীরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি কিছু শব্দ লেখা দেখেছিলেন- যেমন : পানির বোতলগুলোতে ‘সেনা’ (সেনাবাহিনী); ওষুধের পাতায় ডিফেন্স মেডিসিন, বিক্রয় নিষিদ্ধ এবং বন্দি অবস্থায় তাকে যে কোরআন দেওয়া হয়েছিল, সেটি ছিল স্টেশন হেডকোয়ার্টার লাইব্রেরি এবং সেনাবাহিনী লাইব্রেরির।
আয়নাঘরে গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি কামরুজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসানকেও নেওয়া হয়েছিল। ২০২২ সালে আয়নাঘরে তাদের বন্দিদশা ছিল অল্প সময়ের-মাত্র সাত দিন। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরোধের কারণেই তাদের গোপন কারাবরণ বলে তারা উল্লেখ করেন। তারা দুজনই বলেছেন, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে তাদের বাধ্য করা হয়েছে।
তাদের আরও বাধ্য করা হয়, তারা যেন দাবি করেন, টাকার বিনিময়ে গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গোপনে একমত হওয়ার পরে নোবেল বিজয়ী তার বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারে শ্রমিকদের বাধ্য করেছেন।
সরকার ২০২২ সালের ১২ মে জাতিসংঘকে লিখেছিল, কথিত গুমের মামলাগুলো তদন্ত করার পরে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মানুষ প্রায়ই তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা থেকে বাঁচতে স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে চলে যায়। কখনো কখনো তারা পারিবারিক কলহের কারণে বা ব্যবসায়িক দায় এড়াতে আত্মগোপনের পথ বেছে নেয়। কেউ কেউ সরকারকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করে।
তবে শেখ হাসিনার পতনের পরদিন ৬ আগস্ট সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী ও মীর আহমাদ বিন কাসেমকে মুক্তি দেওয়ার পর থেকে এই মিথ্যা প্রকাশ্যে চলে আসে।
আব্দুল্লাহিল আমান আযমী জামায়াতের সাবেক আমির প্রয়াত গোলাম আযমের ছেলে। মীর আহমাদ বিন কাসেম ফাঁসি কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা মীর কাসেমের ছেলে। আয়নাঘরে তাদের আট বছর আটকে রাখা হয়।
সুয়োমোটোতে উল্লেখ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক নিখোঁজ/গুমের অভিযোগ কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়ে কিংবা কারো অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রহণ করে সরকারের কাছে শুধু প্রতিবেদন তলব করতে পারে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ এর ১৮ ধারার সীমাবদ্ধতার কারণে কমিশন এক্ষেত্রে নিজে তদন্ত করতে পারে না। শুধুমাত্র সরকারের দেওয়া প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করতে হয়।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের কাছ থেকে এই প্রতিবেদন পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। আইনের এই সীমাবদ্ধতা কমিশনকে অনেকটা অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। যার আশু সংস্কার প্রয়োজন মর্মে কমিশন মনে করে।
মন্তব্য করুন