চোখের সামনে মাতৃভূমিকে ধ্বংস হতে দিতে পারি না বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়া। তিনি বিজিবি ও সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন।
রোববার (৪ আগস্ট) দুপুরে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে দেশের বিদ্যমান অবস্থার সংকট নিরসনে করণীয় প্রসঙ্গে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান তিনি। ‘বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাবৃন্দ’ এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন।
বক্তব্যের শুরুতে ইকবাল করিম ভূঁইয়া বলেন, গত তিন সপ্তাহ যাবত বাংলাদেশব্যাপী হত্যাযজ্ঞ, গুম এবং গণগ্রেপ্তারের ঘটনা চলছে। আমরা তাতে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও মর্মাহত। কিশোর, তরুণ ও তাজা প্রাণের অকালপ্রয়াণ ঘটনায় অভিভাবক হিসেবে নিজেকে দায়মুক্ত ভাবতে পারছি না। তাই বিবেকের তাড়নায় আমরা দেশবাসীর সামনে হাজির হয়েছি।
তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী এই আন্দোলনে শহীদ সবার আত্মার মাগফিরাত ও দোয়া কামনা করছি। বৈষম্য, ভেদাভেদ ও জুলুমের অবসান করা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার। তা না ঘটে উল্টো এটা আজ দেশের সব পর্যায়ে ভয়াবহভাবে বিস্তার লাভ করেছে। সমাজের নিচের স্তরে পড়ে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সহ্যের সীমার বাইরে চলে গেছে। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ও এর ব্যবস্থাপনা খুব নাজুক, যার প্রতিকার ঘটাতে জনগণ আজ আত্মোৎসর্গ করতে পিছপা হচ্ছে না। এমন কষ্টকর পরিস্থিতির ভেতর দেশবাসীকে ঠেলে দেওয়ার জন্য যারা দায়ী, বিচারের মাধ্যমে তাদের সাজা নিশ্চিত করে পুরো ব্যবস্থার মধ্যে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করা না গেলে সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও আস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে না।
সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেন, দেশের নীতিনির্ধারকরা যদি বিবেক, বুদ্ধি ও হৃদয়হীন হয়ে না পড়তেন, তাহলে গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়, করুণ, মর্মান্তিক এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটত না। এসব হামলা, আক্রমণ ও পাল্টা প্রতিরোধে অঙ্গহানি ঘটেছে অগণিত মানুষের। অন্ধ হয়েছেন বহুসংখ্যক কিশোর ও তরুণ।
তিনি বলেন, অসহায় নাগরিকরা প্রয়োজনীয় এবং জরুরি চিকিৎসাও পাচ্ছেন না। তার ওপরে চলছে ব্লক রেইড করে, সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে বাড়িঘর, মেস থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো ভয়ংকর ঘটনা। মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন অথবা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন হাজার হাজার নিরপরাধ কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী। সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষে দেশে এমন একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি মেনে নেওয়া সম্ভব না। আমরা নিজেরা নিজেদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারি না। আমরা আমাদের দেশটার রাজধানী ঢাকা, বিভাগীয় শহর ও অন্যান্য অঞ্চলে এমন পরিস্থিতি হতে দিতে পারি না। তাই আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছি, ইনশাআল্লাহ তা আমরা করতে দেব না। সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট থাকব।
আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুটা দেশবাসী দেখেছেন, এর কোনো কিছু স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার কথা না। প্রথমত, প্রথমপক্ষ শিক্ষার্থীরা তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সারা দেশের শিশু, কিশোর ও তরুণরা শত উসকানি, হামলা ও নির্যাতনের মধ্যেও ধৈর্য ধরে শৃঙ্খলার সঙ্গে আইন মেনে সামনের দিকে পা বাড়াচ্ছিল। বিপরীতে দ্বিতীয় পক্ষ উসকানি দিল। গুণ্ডা-পাণ্ডা, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি নামিয়ে আকাশে হেলিকপ্টার দিয়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শিশু, কিশোর ও তরুণের তাজা প্রাণ হরণ করল। দেশবাসী কি এত অল্প সময়ে এসব কিছু ভুলে যাবে? আন্দোলনকারীরা গণঅভ্যুত্থানের পথে পা বাড়াতে বাধ্য হলেন। পরবর্তীতে নামানো হলো সেনাবাহিনীকে। তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কখনো সম্মুখে, কখনো পিছনে ও পাশে দাঁড় করিয়ে অন্য বাহিনীগুলো এ গণআন্দোলনের ওপর অব্যাহতভাবে জুলুম-অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই এমন দায় দেশপ্রেমী সেনাবাহিনীর নেওয়া উচিত নয়।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কখনো জনেগণের মুখোমুখি দাঁড়ায়নি। তাদের দিকে বন্দুক তাক করেনি। একটি রাজনৈতিক সংকটকে সামরিকীকরণের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে আমরা সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এর তীব্র বিরোধিতা করছি।
মন্তব্য করুন