বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ড. ইউনূস বর্তমানে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থান করছেন। সেখানে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ‘দ্য হিন্দু’র খ্যাতনামা কূটনৈতিক সংবাদদাতা সুহাসিনী হায়দার, যিনি ব্যক্তিগতভাবে বহুলালোচিত বিজেপি নেতা সুব্রাহ্মণিয়াম স্বামীর মেয়ে এবং ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সালমান হায়দারের পুত্রবধূ। গত ২৬ জুলাই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হয়েছে। ড. ইউনূসের সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ তুলা ধরা হলো..
সুহাসিনী হায়দার: বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনি কী শুনেছেন? সে সম্পর্কে আমাদের একটি ধারণা দিন। আপিল আদালতের নতুন রায়ের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে মনে হচ্ছে...?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: আমি এখানে [অলিম্পিক অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি হিসেবে প্যারিসে] আসার পর এমন কিছু ঘটেনি। আমি সেখানে ছিলাম। কারফিউর মধ্য দিয়ে এয়ারপোর্টে গেলাম। বাংলাদেশে যে ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে এবং এ পরিস্থিতিতে আমি বিশ্বনেতাদের কাছে এ হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা যায় কি না তা দেখার জন্য আবেদন করছি। আমি এটা দেখে সহ্য করতে পারি না, লাখ লাখ বাংলাদেশি সন্ত্রাসের মধ্যে বসবাস করছে। গণতন্ত্র মানুষের জীবনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। গণতন্ত্র হলো- ধর্ম, রাজনৈতিক মতামত বা মতের অন্য কোনো পার্থক্য নির্বিশেষে মানুষকে, সব মানুষকে রক্ষা করা। কোনো নাগরিক যদি অন্য কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করতে চায়, তাহলে রাষ্ট্রের প্রথম দায়িত্ব হলো আক্রমণের শিকার ব্যক্তিকে রক্ষা করা। আক্রমণকারীকে হত্যা করা সর্বশেষ বিকল্প, প্রথম বিকল্প নয়, আর বাংলাদেশ সরকার শেষ বিকল্পেই সাড়া দিয়েছে। বিক্ষোভকারীরা কাউকে হত্যা করার জন্য বাইরে বের হয়নি। তাদের দাবি সরকারের কাছে অপ্রীতিকর হতে পারে, কিন্তু এটি সরকারকে তাদের হত্যা করার জন্য গুলি করার সুযোগ দেয় না।
সুহাসিনী: আপনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছেন, জাতিসংঘকে এর সঙ্গে জড়িত হওয়ার জন্য বলেছেন। আপনি ঠিক কীভাবে তাদের ভূমিকা পালন দেখতে চান?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: আমি কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া চাচ্ছি না। আমি আশা করছিলাম যে, তারা তাদের অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক এবং অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলো ব্যবহার করে আমাদের নেতাদের সংযত করতে, গণতন্ত্রের আদর্শ থেকে গুরুতর প্রস্থান সম্পর্কে সচেতন করতে পারে। একটি বন্ধুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে, ফোন তুলে বলতে পারে, সেখানে কী হচ্ছে? বন্ধুরা বন্ধুদের জন্য যে ধরনের কাজ করে, সেটি ঠাণ্ডা করার কিছু উপায়, যা মানুষের জীবন বাঁচাতে সহায়ক হবে। নেতাদের মধ্যে বন্ধুত্ব আছে। বন্ধু হিসেবে কিছু করা যায়। সংকটের সময়ে ভালো উপদেশ না দিলে বন্ধু কিসের?
সুহাসিনী: ভারত ও বাংলাদেশ ঐতিহাসিক বন্ধু। তবে ভারত আগেই বিবৃতি দিয়ে বলেছে- এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: আপনি একজন পাবলিক ফিগার হিসেবে জনসমক্ষে এটি বলতে পারেন, তবে আপনি এখনো আপনার বন্ধুত্বকে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীরা হয়তো একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে পারেন যদি তারা দেখেন যে কিছু ভুল হচ্ছে। আমাদের এখনো সার্কের স্বপ্ন আছে। আমরা একে অপরকে সাহায্য করি। আমরা একে অপরের জন্য সম্পর্ককে সহজ করি। আমাদের মধ্যে প্রাকৃতিক বন্ধন আছে। এক দেশে কিছু ঘটলে অন্য দেশে স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। আমরা যা দেখছি তা হলো- নিরীহ মানুষ নিহত হচ্ছে। এটা খুবই অদ্ভুত পরিস্থিতি। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মোকাবিলায় নিরাপত্তা বাহিনীকে আনতে হবে কেন? এখন আপনি বলেন, ভিতরে কিছু শত্রু আছে। কারা সেই শত্রু? তাদের চিহ্নিত করুন এবং তাদের মোকাবিলা করুন, ছাত্রদের হত্যা করে সেটি নয়। একটি গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন যেভাবে চলবে সেটি এরকম নয়।
সুহাসিনী: ভারতে, বিশেষ করে ১৯৭১ সালের কোটা নিয়ে বিক্ষোভের বিষয়ে উদ্বেগ হলো যে, এটি ভারতবিরোধী মনোভাবকে উসকে দিচ্ছে। আপনি এটি কতদূর সত্য বলে মনে করেন?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: এটি চিন্তা করাটা কল্পনাকে অনেক দূরে প্রসারিত করা হবে। কোটা আন্দোলনের সামান্যতম ছোঁয়াও নেই বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে। সমস্যা হলো গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার, বিচার বিভাগের ভূমিকা। জনগণের মতামত প্রকাশের অধিকার রয়েছে এবং তাদের মতামতের জন্য তাদের হত্যা করার অধিকার সরকারের নেই।
সুহাসিনী: প্রতিবাদগুলোকে যেভাবে মোকাবিলা করা হয়েছে তাতে আপনি আপত্তি করছেন। হাসিনা সরকার বলছে- বিক্ষোভকারীরা নিজেরাই হিংস্র হয়ে উঠেছে, তারা পুলিশ পোস্টে আক্রমণ করেছে...
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: যারা আইন ভঙ্গ করেন তাদের সঙ্গে আপনি কীভাবে মোকাবিলা করবেন তার একটি পদ্ধতি রয়েছে। কিছুই বলে না যে আপনাকে এলোমেলোভাবে হত্যা করতে হবে। বিশ্বে এটিই প্রথম নয় যেখানে কোনো সরকারকে বিক্ষোভের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমরা দেখি পুলিশ নিরপরাধ ছাত্রদের প্রতি হাত তুলে গুলি করছে এবং খুব কাছ থেকে গুলি করছে, কারণ তাদের গুলি করার ক্ষমতা আছে। এটাই আমরা দেখতে পাই।
যদি বিক্ষোভকারীরা উচ্ছৃঙ্খল হয় তবে এ ধরনের পরিস্থিতি পরিচালনা করার জন্য অনুসরণীয় পদ্ধতি রয়েছে। বাংলাদেশে আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের চর্চায় মারাত্মক কিছু ভুল আছে। আসুন আমরা আমাদের নিজেদের সুবিধার জন্য এখান থেকে মুখ ফিরিয়ে না নিই। আমরা সার্কের সদস্য। আমরা প্রতিবেশী। সব মিডিয়ার এসে দেখা উচিত এখানে কী হচ্ছে। তারা [বাংলাদেশ সরকার] প্রথম যে কাজটি করেছিল, তা হলো- সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া, যাতে তারা অন্ধকারের আড়ালে এমন কিছু করতে পারে যাতে কেউ বাইরে থেকে না দেখে, এমনকি ভিতরে থেকেও তা দেখতে না পারে। কেন তারা নিজেদের মানুষকে ভয় পায়?
সুহাসিনী: শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং মন্ত্রীদের পদত্যাগসহ তাদের দাবির তালিকা প্রকাশ করেছে শিক্ষার্থীরা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: এগুলো ছাত্রদের দাবি এবং পদ্ধতিটি হলো সরকারের সে জিনিসগুলোতে সাড়া দেওয়া। কিন্তু যেভাবে কাজ করছে সেটি কাঙ্ক্ষিত নয়।
সুহাসিনী: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবেমাত্র নির্বাচনে জিতেছেন [২০২৪ সালের জানুয়ারিতে]। পদত্যাগের আহ্বান কি অগণতান্ত্রিক নয়?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা গণতন্ত্রের জন্য এবং গণতন্ত্রের সঙ্গে থাকার জন্য নিজেদের অঙ্গীকারবদ্ধ করেছি। আপনি সদ্য নির্বাচিত হন বা আপনি নির্বাচিত না হন, অথবা আপনি জনগণের সম্মতি ছাড়া আপনার পদের অপব্যবহার করেন, গণতন্ত্রে কিছু যায় আসে না। জনগণকে রক্ষার দায়িত্ব সরকারের, মানুষ হত্যা নয়। আপনি কাউকে তুলে নিতে পারবেন না, কোনো ব্যক্তি বিরোধী দলের সদস্য বলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে- তা হতে পারে না। সরকার তাকে কাল্পনিক অপরাধে অভিযুক্ত করে গ্রেপ্তার করতে পারে। এজন্য তাকে জেলে থাকতে হবে। এটা আইনের শাসন নয়। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কিছু পদ্ধতি অবশ্যই থাকতে হবে।
সুহাসিনী: এর বাইরে এসব বিক্ষোভের ভবিষ্যৎ কী?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: গণতন্ত্র যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে আপনি জনগণের ম্যান্ডেট নিন, জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা পেতে আবার জনগণের কাছে ফিরে যান, এই মুহূর্তে সরকারের কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা অবশিষ্ট নেই।
সুহাসিনী: আপনি কি মনে করেন সরকারের পদত্যাগ করা উচিত?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে উদ্ভূত এ ধরনের পরিস্থিতিতে যা আদর্শ তা করতে হবে। গণতন্ত্র সব সমাধান দিয়েছে। আমাকে নতুন করে রায় দিতে হবে না।
সুহাসিনী: পরিস্থিতির উন্নতিতে আপনি কি কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেন?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: [বাংলাদেশে] গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করছি, আমি এ মুহূর্তে এই ভূমিকাই পালন করছি।
সুহাসিনী: সরকার আপনার বিরুদ্ধে প্রায় ২০০টি অভিযোগ দায়ের করেছে। শ্রম আইনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং দুটি নতুন মামলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এ লড়াই কি ব্যক্তিগত?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: এসব মামলাও আইনের শাসনের ব্যর্থতা। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো আত্মসাৎ, জালিয়াতি এবং অর্থপাচার সংক্রান্ত। বলা হচ্ছে- আমি আমার নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা চুরি করেছি। এগুলো সরকারের অভিযোগ। এগুলো সম্পূর্ণ বানোয়াট গল্প, সবই বানানো। অনেক মানবাধিকার সংস্থা এগুলোকে ভিত্তিহীন বলেছে। এটা আমাকে হয়রানি করার জন্য। শ্রম আইন লঙ্ঘনের একটি মামলায় আমি ইতোমধ্যেই ছয় মাসের কারাদণ্ড পেয়েছি, যা আরেকটি বানানো মামলা।
সুহাসিনী: আপনি কি মনে করেন যে বাংলাদেশকে এই বিন্দু থেকে গণতন্ত্রের নিয়মে আবার ফিরিয়ে আনা যেতে পারে, যা আপনি ব্যর্থ হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: অবাধে এবং ন্যায্যভাবে জনগণের ম্যান্ডেট নিন। সমাধান এটাই। জনগণের নির্দেশনাই সমস্যার সমাধান করে, কারণ রাষ্ট্র জনগণের, সরকারের কিছু লোকের নয়।
সুহাসিনী: আপনি কি আরেকটি নির্বাচনের পরামর্শ দিচ্ছেন?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্য নির্বাচনই সব রাজনৈতিক সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান। যখন কিছু কাজ করে না, আপনি লোকদের কাছে ফিরে যান তাদের নির্দেশনা চাইতে। তারাই দেশের চূড়ান্ত মালিক। নিশ্চিত করুন যে, এটি একটি সত্যিকারের নির্বাচন হবে, জাদুকরের নির্বাচন নয়।
সুহাসিনী: আপনি কি মনে করেন যে সহিংসতার পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে এবং আপিল আদালত কোটা কমিয়ে দেওয়ার পরও বিক্ষোভ ফিরে আসতে পারে?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: সরকার দাবি করছে [পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে]। এমনকি এটি থামলেও এর অর্থ এই নয় যে মৌলিক রাজনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধান করা হয়েছে। এটি সাময়িকভাবে থামতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক ইঞ্জিন চলতে থাকবে, মুহূর্তের বিজ্ঞপ্তিতে তা আবার ফিরে আসতে পারে। আজ বাংলাদেশে যা হচ্ছে তা ভারতেও ঘটতে পারে। আপনি যদি আজ কথা না বলেন, আপনি এই দিনটিকে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান বা অন্য সার্ক দেশগুলোর জন্য সহজেই কাছে নিয়ে আসবেন।
সূত্র: দ্য হিন্দু
মন্তব্য করুন
আর্কাইভ 
| ২৩ নভেম্বর ২০২৪ 
