কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতার পর কারফিউ জারির চতুর্থ দিন মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) রাজধানীর সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। সহিংসতা না থাকায় সড়কে বেড়েছে মানুষের চলাচল। কিছুটা স্বস্তি নিয়ে বাইরে বের হয়েছেন নগরবাসী। তবে সবার মনে এখনো রয়েছে অজানা উৎকণ্ঠা। পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষায় তারা।
গত কয়েকদিনের মতো মঙ্গলবারও সড়কে টহল দিয়েছে সেনাবাহিনী। সড়কের মোড়ে মোড়ে ছিল চেকপোস্ট। প্রয়োজন ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বের হলেই চেকপোস্টে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। সড়কে রিকশা, সিএনজি অটোরিকশা ও ব্যক্তিগত যানবাহনের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। দু-একদিনের মধ্যে পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হওয়ার আশা করছেন রাজধানীবাসী।
সরেজমিন নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকার প্রধান সড়কগুলো অনেকটা ফাঁকা। বন্ধ রয়েছে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানসহ অফিস-আদালত। তবে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে ঢাকার প্রবেশপথগুলো। সড়কে পড়ে থাকা ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিলের সময় সড়কে বেড়েছে মানুষ ও যানবাহনের উপস্থিতি। কেউ ছুটে গেছেন কাঁচাবাজারে, কেউবা ওষুধের দোকানে। অনেকেই কিনে রেখেছেন কয়েকদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। পাড়া-মহল্লায় ক্রিকেট ও ফুটবল খেলে সময় পার করেছেন কিশোর-তরুণরা। নগরীর ৮ থেকে ১০টি পয়েন্টে সড়কে দেখা দিয়েছে যানজট। বিকেল ৫টা বাজতেই সড়কে যানবাহন ও মানুষের চলাচল সীমিত হয়ে এসেছে। সবাই বাসায় ফিরলেও সন্ধ্যার পর অনেকেই বাইরে বের হয়েছেন। বাসার আশপাশের মাঠ-খোলা জায়গায় আড্ডা দিতে দেখা গেছে নগরবাসীর। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি দেখলেই বাসায় ঢুকে পড়েন তারা।
ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা কলেজছাত্র আরিফুল ইসলাম বলেন, স্কুল-কলেজ বন্ধ, ইন্টারনেট বন্ধ, গণপরিবহন চলাচল বন্ধ। কোথাও যাওয়া যাচ্ছে না। বাসায় কতক্ষণ মন টেকানো যায়। তাই বন্ধুরা মিলে সড়কে শর্ট ক্রিজে ক্রিকেট খেলছি।
মঙ্গলবার হাইকোর্ট, সচিবালয়, সেগুনবাগিচা, গুলিস্তান, বঙ্গভবন ও মতিঝিল এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। সতর্ক রাখা হয়েছে রায়টকার ও সাঁজোয়া যান। মোড়ে মোড়ে টহল দিয়েছেন সেনাসদস্যরা। বাইরে বের হওয়া লোকজন চেকপোস্টে জিজ্ঞাসাবাদে সদুত্তর দিতে না পারলে তাকে গন্তব্যে যাওয়া থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সংসদ ভবন ও বিমানবন্দর এলাকায় কড়াকড়ি দেখা গেছে। স্বাভাবিক চেহারায় ফিরেছে যাত্রাবাড়ী, কাজলা, শনির আখড়া ও রায়েরবাগ এলাকা। মোহাম্মদপুর, বছিলা, শ্যামলী ও আসাদগেট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় দেখা গেছে।
পুরান ঢাকার ব্যবসার হাব চকবাজার ও মৌলভীবাজারে দোকানপাট খুলেছে। দোকানের অর্ধেক শাটার খুলে কেনাবেচা চলছে। চাল-ডাল, মসলা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর পাইকারি দোকানগুলোতে দেখা গেছে উপচে পড়া ভিড়।
সপ্তাহখানেক ধরে জনজীবন স্থবির থাকায় কষ্টে রয়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিপণিবিতানে বন্ধ রয়েছে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। কাজের অভাবে ঢাকা ছাড়ছেন খেটে খাওয়া মানুষ। যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় দেখা গেছে, ঢাকার লোকাল কয়েকটি বাস শরীয়তপুরগামী যাত্রী তুলছে। ভাড়া নেওয়া হচ্ছে দ্বিগুণ।
গুলিস্তানের দোকান কর্মচারী ফিরোজ হোসেন বলেন, দোকান বন্ধ থাকায় আয় বন্ধ। কবে খুলবে, তার নিশ্চয়তা নেই। তাই বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। ২৫০ টাকার বাস ভাড়া ৫০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।
যাত্রাবাড়ী থেকে প্রাইভেটকার ও অ্যাম্বুলেন্সে করে অনেকে বিভিন্ন গন্তব্যে রওনা দিয়েছেন। কেউ কেউ ভেঙে ভেঙে রাজধানী ছেড়েছেন। যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া ও সাইনবোর্ডে যাওয়ার পর অল্পকিছু যানবাহন পাওয়ার কথা জানিয়েছেন যাত্রীরা।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী আসিফ ইকবাল বলেন, পরিবার গ্রামে থাকে। আমি ঢাকায় থাকি চাকরির প্রয়োজনে। অফিস-আদালত কবে খুলবে জানি না। তাই ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছি।
ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ঢাকায় বেড়েছে ছাপা পত্রিকার চাহিদা। তবে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে পত্রিকা। মঙ্গলবার দেরিতে স্টলে গিয়ে পত্রিকা পাননি আজহার হোসেন। তিনি বলেন, তিনটি পত্রিকা কিনলাম ২-৩ টাকা বাড়তি দাম। অতিরিক্ত দামের প্রতিবাদ করলে হকার বললেন, কিনলে কেনেন না হলে বাদ দেন।
ঢাকা সংবাদপত্র হকার্স সমিতির সভাপতি আবদুল মান্নান জানান, পত্রিকার চাহিদা বেড়েছে ১৫ শতাংশ। তবে কারফিউর সময় অনেকে পত্রিকা সংগ্রহ করতে পারছেন না, স্টল বন্ধ থাকায় পত্রিকা কিনতে এসে ফিরে যাচ্ছেন।
মন্তব্য করুন