সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কর্মসূচি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে কোটা আন্দোলনকারীদের মধ্য সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে। এক পক্ষ বলছেন কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকার বিরোধী কর্মসূচি দেয়াটা সমীচীন নয়। এতে সারাদেশে সাধারণ মানুষের যে সহানুভূতি তৈরি হয়েছে তাতে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। অপর পক্ষ বলছেন, এই আন্দোলনকে সরকার বিরোধী আন্দোলনের রূপ দিয়ে ক্ষমতার পট পরিবর্তন ঘটাতে চান তারা। এ নিয়ে দু পক্ষের মধ্যে তৈরি হয়েছে সমন্বয়হীনতা। কারণ এর আগে সকল কর্মসূচি আলোচনার ভিত্তিতে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ঘোষণা করা হয়েছিল। এবারেই সবার অলক্ষে আলোচনা না করেই কয়েকজন সারাদেশে শাটডাউন এর মত কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে নানান কর্মসূচি দিয়ে দাবি আদায়ের চেষ্টা করছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, সরকারও ছিল শিক্ষার্থীদের প্রতি নমনীয়। ছাত্রলীগ পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকলেও বাঁধা দেয়নি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বরং একপ্রকার সমর্থনেই দিয়ে যাচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করে অনেক শিক্ষার্থী। আর বিষয়টিকে উসকে দেয় শিবির এবং ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। বাংলা এবং বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করে রাজাকার স্লোগানও দেন তারা।
এরপর বিএনপি এবং জামাতের ইন্ধনে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন রূপ নেয় সংঘর্ষে। বিশেষ করে গত ২দিন ধরে যা হচ্ছে তাতে অনুমেয় যে কোটা দাবির আড়ালে উদ্দেশ্য সরকারের পতন। কয়েকটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন এখন আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাতে নেই। এখন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
বিশেষ করে সমন্বয়কদের মধ্য হাসনাত আব্দুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, নাহিদ ইসলাম, আবদুল হান্নান মাসুদসহ বড় একটা অংশ সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে আগে থেকেই সম্পৃক্ত ছিল। এর মধ্য নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদ গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি নামে একটি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন এই সংগঠনটির সভাপতি দায়িত্ব পালন করছেন। সংগঠনে যুক্ত হওয়ার আগে তিনি শিবিরের রাজনীতি করতেন বলে অনেকেই জানিছেন।
গত মঙ্গলবার থেকেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন রূপ নেয় সহিংসতায়। বিশেষ করে বিকেলের দিকে। একদিনেই বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষে অন্তত ৭ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তার জের ধরে মঙ্গলবার রাত থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সংঘবদ্ধ হয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের লক্ষ করে হামলা চালাতে থাকে। মঙ্গলবার রাত থেকে শুরু করে গতকাল বুধবার দুপুরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আন্দোলনকারীরা। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ , রাজশাহী , কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মারধর করে বের করে দেয়া হয়। রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সভাপতি ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আতিকা বিনতে হোসেনকে চুলের মুঠি ধরে মারতে মারতে হল থেকে বের করে দেয়া হয়। প্রাণভয়ে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেত্রী বোরকা পড়ে হল ছাড়েন। সকালে আরও এক নেত্রীকে পেয়ে কান ধরে উঠবস করান শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও সরকারি বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের কয়েকজন ছাত্রলীগ নেত্রীকে খুঁটির সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতেও দেখা যায়।
হামলার হাত থেকে বাদ যায়নি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও আওয়ামী লীগের অফিসও। কক্সবাজার, গাইবান্ধা, বগুড়া, চট্রগ্রাম, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপরেও হামলা ঘটনা ঘটেছে। আগুন দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের অফিসেও। গাইবান্ধায় আওয়ামী লীগের অফিসের সামনে থাকা ১১ টি মোটর সাইকেলে আগুন দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। এছাড়াও রাজধানীর যাত্রাবাড়ি দুই গ্রুপের সংঘর্ষে রনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আগুন দেয়া হয়েছে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায়। স্থানীয় আওয়ামী লীগের অফিসেও আগুন দেন তারা।
নতুন কর্মসূচি: নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। কোন ধরনের মিটিং কিংবা সংবাদ সম্মেলন না করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে এ কর্মসূচি জানিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে উপর পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, সোয়াটের ন্যাক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত ও এক দফা দাবিতে আগামীকাল ১৮ই জুলাই সারাদেশে "কমপ্লিট শাটডাউন" ঘোষণা করছি। শুধুমাত্র হাসপাতাল ও জরুরি সেবা ব্যতীত কোন প্রতিষ্ঠানের দরজা খুলবে না, এ্যাম্বুলেন্স ব্যতীত সড়কে কোন গাড়ি চলবে না। সারাদেশের প্রতিটি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানাচ্ছি আগামীকালকের কর্মসূচি সফল করুন।
আমাদের অভিভাবকদের বলছি, আমরা আপনাদেরই সন্তান। আমাদের পাশে দাঁড়ান, রক্ষা করুন। এই লড়াইটা শুধু ছাত্রদের না, দলমত নির্বিশেষে এদেশের আপামর জনসাধারণের।
কোটা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা একাধিক শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের প্রতি যে সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন তাতে তারা সন্তুষ্ট। জামাত এবং বিএনপির মতাদর্শের কয়েকজন সমন্বয়ক কঠোর মনোভাব পোষণ করেন। এই আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে বিপাকে ফেলতে চান বলে স্পষ্ট করে দেন। ফলে মতানৈক্যের মধ্য দিয়েই একপক্ষ শাটডাউন এর মত কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
সূত্র বলছে, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দাবি জানিয়েছেন কেবল কোটা সংস্কারের। তারা সরকারের সুনাম ক্ষুন্নের বিপক্ষে দাঁড়াতে চাচ্ছেন না। আন্দোলনকারীদের একাংশ চাচ্ছেন শিক্ষার্থীদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে যেকোনো মূল্যে সরকারের পতন। আর এ কারণেই সবার সঙ্গে আলোচনা না করে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে শাটডাউনের।
গতকাল অন্তত ১৫ জন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা হয় কালবেলার। তারা প্রত্যেকেই বলছেন, প্রধানমন্ত্রী যেহেতু নমনীয় সেক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন শেষ করা উচিত। কিন্তু সমন্বয়কদের একটি পক্ষ আন্দোলনকে সারাদেশে সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ দেয়ার চেষ্টা করছেন।
ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, কোটা আন্দোলনের যেসব সমন্বয়করা রয়েছেন তারা বেশিরভাগই সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। আগেও তাদের নিষিদ্ধ সংগঠন শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ রয়েছে। আর সেই যের ধরে শিবির ছাত্রদলের পরামর্শে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উপর হামলা চালায়। এমনকি দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পার্টি অফিসে তাদের নির্দেশনাতেই হামলা চালাচ্ছেন।
তিনি বলেন, আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাতে নেই। এটা অনেক আগেই ছিনতাই হয়ে গেছে। দেশব্যাপী নৈরাজ্য চালানোর জন্য নতুন এ হঠকারী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। শিক্ষার্থীদের যে দাবি সেই দাবির সঙ্গে সারাদেশে এ ধরনের কর্মসূচির কোন মিল নেই।
মন্তব্য করুন