‘আমি কি একটি সোডা পেতে পারি?’-এই ছিল ৫৮ বছর বয়সী এক ব্যক্তির প্রথম কথা, যা তিনি একটি ক্লিপবোর্ডে লিখেছিলেন তার ঐতিহাসিক অপারেশনের পরে জেগে ওঠার পর। দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিকল্পিত এই অপারেশনটি গত ৯ জুলাই টেক্সাস হার্ট ইনস্টিটিউটে (হিউস্টন) সম্পন্ন হয়।
এই অপারেশনটি একটি যুগান্তকারী সাফল্য যা অস্ট্রেলিয়ান উদ্ভাবিত টাইটানিয়াম হার্ট প্রতিস্থাপন করার জন্য করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো BiVACOR যা কিনা সম্পূর্ণ একটি কৃত্রিম হার্ট একজন জীবিত মানুষের দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়।
অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে জন্ম নেওয়া ৪৫ বছর বয়সী বায়োমেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ড্যানিয়েল টিমস, যিনি এই কৃত্রিম হার্টের উদ্ভাবক, তিনি সাড়ে চার ঘণ্টার সার্জারির সময় উপস্থিত ছিলেন। এই সময়ে রোগীর রোগাক্রান্ত হার্টটি সরিয়ে অস্ট্রেলিয়ান উদ্ভাবিত ৬৫০ গ্রাম ওজনের টাইটানিয়াম হার্টটি প্রতিস্থাপন করা হয়। এটি রক্ত সঞ্চালনের জন্য চুম্বকীয় উত্থাপন এবং একটি স্থিতিশীল ঘূর্ণায়মান ডিস্ক ব্যবহার করে যা একটি গেম চেঞ্জার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এর দাম প্রায় ২০০,০০০ মার্কিন ডলার।
২০০১ সালে ড্যানিয়েল টিমসের বাবা গ্যারি হৃদরোগে আক্রান্ত হন, যা ড্যানিয়েলকে কৃত্রিম হার্টের দিকে মনোযোগ দিতে প্রেরণা দেয়। ২০০৬ সালে টিমসের প্রাথমিক কৃত্রিম হার্ট একটি ভেড়ার দেহে ইনপ্ল্যান্ট করা হয়। সেই বছরেই তার বাবা গ্যারি টিমস হৃদযন্ত্রের অক্ষমতার কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৮ সালে ড্যানিয়েল টিমস এবং হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ জন ফ্রেজার যৌথভাবে বায়ভ্যাকর প্রতিষ্ঠা করেন।
অতীতে অনেক কৃত্রিম হার্ট উদ্ভাবিত হয়েছে এবং মানুষের ওপর পরীক্ষা করা হয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগ কৃত্রিম হার্টের মডেল দীর্ঘকালীন সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এক্ষেত্রে, টিমসের উদ্ভাবন এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।
ড্যানিয়েল টিমসের উদ্ভাবিত কৃত্রিম হার্ট ‘বায়ভ্যাকর’ একটি একক ঘূর্ণায়মান ডিস্ক ব্যবহার করে শরীরের রক্ত সঞ্চালন করে। এই ডিস্কটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে এটি চেম্বারের অন্য কোনো অংশকে স্পর্শ করে না, কারণ এটি ম্যাগনেটিকালি লেভিটেড অর্থাৎ ম্যাগলেভ সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত। এই কারণে ডিস্কের ওপর ঘর্ষণ কমে আসে এবং এর কারণে রোগীর কোনো পালস হয় না।
যদিও এই ধারণাটি চিকিৎসকদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করেছে। অনেকেই মনে করেন যে শরীরের জন্য পালস অপরিহার্য, এবং তারা টিমসের উদ্ভাবনের সম্ভাবনা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। ‘মেডিকেল কমিউনিটি বলেছিল, ‘এটা কখনোই কাজ করবে না। শরীরের পালস দরকার। কেউই এই পথে যেতে চায়নি,’ বলেছেন টিমস।
বর্তমানে বিদ্যমান হার্ট প্রতিস্থাপন কেবল বাম দিকের হার্ট পরিবর্তন করে, কিন্তু বায়ভ্যাকর দুই দিকই প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম। এটি সম্পূর্ণ হার্ট ফেইলওর রোগীদের জন্য একটি সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে। ‘যদি সব কিছু আমাদের আশা অনুযায়ী চলে, তবে এটি অনেক রোগীর জন্য হার্ট প্রতিস্থাপন পরিবর্তন করতে পারে,’ বলেছেন টিমস।
অপারেশনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঁচজন রোগীর জন্য একটি প্রাথমিক সম্ভাব্যতা অধ্যয়নের প্রথম ধাপ ছিল। মেডিকেল রিসার্চ ফিউচার ফান্ড দ্বারা অর্থায়িত দ্বিতীয় ক্লিনিকাল ট্রায়ালে সিডনির সেন্ট ভিনসেন্ট এবং মেলবোর্নের দ্য আলফ্রেড হাসপাতালে আরও ১০ জন অস্ট্রেলিয়ান রোগী এ ডিভাইসটি পাবেন। এ সফল প্রতিস্থাপন বিশ্বব্যাপী হৃদরোগীদের জন্য একটি নতুন আশার আলো হয়ে উঠেছে। এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে যা ভবিষ্যতে আরও উন্নত এবং কার্যকর প্রতিস্থাপনের দিকে ইঙ্গিত করছে।
মন্তব্য করুন