বাংলাদেশের হ্যান্ডওয়াশ ও টুথপেস্টে উদ্বেগজনক মাত্রায় প্যারাবেন পাওয়া গিয়েছে। সাধারণত অধিক কার্যকরী এবং সাশ্রয়ী হওয়ায় ‘পারসোনাল কেয়ার প্রোডাক্টে প্রিজারভেটিভ’ হিসেবে প্যারাবেন ব্যবহার হয়। এ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ মানবদেহের হরমোন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ এন্ড্রোকাইন সিস্টেমের কার্যক্রমকে ব্যাহত করে। এটি নিয়মিত ব্যবহারে হতে পারে হৃদ্রোগ বা ক্যানসারের মতো জটিল ব্যাধি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা এসডোর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) এসডোর প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মলনে গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়। গবেষণাটি পরিচালিত হয় দক্ষিণ কোরিয়ার ওনজিন ইনস্টিটিউট ফর অকুপেশনাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হেলথ (ডাব্লিউআইওইএইচ) এর সহযোগিতায়।
মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা বিবেচনায় নিয়ে এই গবেষণা পরিচালনা করে এসডো। বাংলাদেশের জনপ্রিয় টুথপেস্ট এবং হ্যান্ডওয়াশগুলোয় প্যারাবেনের ব্যবহারের মাত্রা অনুসন্ধান করা হয় গবেষণায়।
ঢাকার বিভিন্ন স্থানীয় দোকান থেকে টুথপেস্ট এবং হ্যান্ডওয়াশের ৩০টি নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাব পরীক্ষার জন্য ডব্লিউআইওইএইচ-এ পাঠানো হয় গবেষণা পরিচালনায়।
গবেষণায় দেখা যায়, টুথপেস্ট এবং হ্যান্ডওয়াশের সকল নমুনাতেই নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রার ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি রয়েছে।
নমুনাগুলোয় ফ্লোরাইড (শুধু টুথপেস্টে) এবং সোডিয়াম ডাইক্লোরাইডের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। প্রাপ্তবয়স্কদের পারসোনাল কেয়ার প্রোডাক্টে ২২টি নমুনার মধ্যে ৫টি পণ্যে সর্বোচ্চ মাত্রায় প্যারাবেনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিশেষ করে, একটি টুথপেস্টে ১৮২৩ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম এবং দুটি হ্যান্ডওয়াশের নমুনায় ১৪০৩-১৮৩৪ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম প্যারাবেনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
এমনকি শিশুদের একটি টুথপেস্টেও ৬৫৯ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম মিথাইলপ্যারাবেন এবং ৫০.৫ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম বিউটাইলপ্যারাবেনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
সাতটি অন্যান্য দেশের নমুনাও বিশ্লেষণ করা হয় এ গবেষণায়। কিন্তু বাংলাদেশি পণ্যগুলোতেই বেশি মাত্রায় প্যারাবেন ব্যবহার করা হয়।
গবেষণাটিতে মানব স্বাস্থ্যের ওপর এসব রাসায়নিক পদার্থের সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাবের বিষয়গুলোও তুলে আনা হয়েছে। যেমন প্যারাবেনের কারণে হরমোন নিয়ন্ত্রণে ব্যাঘাত, প্রজনন সমস্যা এবং এমনকি ক্যানসারের ঝুঁকিও সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে ফ্লোরাইডের অতিরিক্ত ব্যবহার হাড়ের ভারসাম্য নষ্ট করে এবং দাঁতের এনামেল গঠনে সমস্যা তৈরি করে।
তা ছাড়া অতিরিক্ত সোডিয়াম ডাইক্লোরাইড ব্যবহারের ফলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনির সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে।
এসডোর চেয়ারপারসন এবং সাবেক সচিব সৈয়দ মারগুব মোর্শেদ দৈনন্দিন ব্যবহৃত ব্যক্তিগত পরিচর্যা পণ্যতে প্যারাবেনের উপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সরকারের প্রতি এই রাসায়নিকের ব্যবহার নিষিদ্ধের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
এসডোর সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবুল হাশেম বলেন, আমাদের দৈনন্দিন পণ্যে এত উচ্চমাত্রায় এই বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার দেখে আমি অনেক উদ্বিগ্ন। এগুলো নীরবে আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে যাচ্ছে এবং আমাদের জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দিকা সুলতানা অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলের সামনে পারসোনাল কেয়ার প্রোডাক্টে ব্যবহৃত প্যারাবেনের ক্ষতিকারক প্রভাব এবং ঝুঁকিগুলো তুলে ধরেন। তিনি সবাইকে সতর্ক করে বলেন, এই রাসায়নিকগুলো এন্ডোক্রাইন ডিসরাপ্টর হিসেবে ক্লাসিফাই করা হয়। এগুলো আমাদের শরীরের হরমোন নিয়ন্ত্রণে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে এবং প্রজনন সংক্রান্ত জটিলতাও সৃষ্টি করতে পারে।
প্রসঙ্গত, প্যারাবেন হলো এক ধরনের রাসায়নিক যা সাধারণত প্রসাধনী, পারসোনাল কেয়ার প্রোডাক্ট (শ্যাম্পু, ডিওডোরেন্ট, হ্যান্ডওয়াশ) এবং ওষুধপত্রের স্থায়িত্ব বাড়াতে ব্যবহৃত হয়। কার্যকর প্রিজারভেটিভ বা সংরক্ষক হিসেবে কাজ করে এগুলো। প্যারাবেন কম খরচ এবং সহজলভ্য হওয়ার কারণে উৎপাদনকারীরা এটি বেশি পরিমাণে ব্যবহার করে থাকে।
মন্তব্য করুন