আর্থ্রাইটিস কী?
আর্থ্রাইটিস বলতে সাধারণত জয়েন্ট বা গাঁটের ব্যথাকে বোঝানো হয়। মানবদেহের বিভিন্ন অংশে দুটি হাড় যে অংশে মিশে তাকে জয়েন্ট বলা হয়। ছোট-বড় সব জয়েন্টেই আর্থ্রাইটিস হতে পারে। এক সময়ে বৃদ্ধরা আক্রান্ত হলেও সম্প্রতি সময়ে তরুণ এবং মধ্যবয়সীরা এরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। মানুষের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কিছু হাড়ের স্বাভাবিক পরিবর্তন ও ক্ষয় হয়। সেখান থেকে এমন সমস্যা দেখা দিতে পারে। আবার অনেক সময় আঘাতের কারণেও আর্থ্রাইটিস হয়ে থাকে।
দেহের যেসব অংশে বেশি আর্থ্রাইটিস হয়ে থাকে : হাতের কব্জি, হাঁটু, কোমর, পায়ের গোড়ালি, কাঁধ, পিঠের নিচের অংশ (মেরুদণ্ড)।
আর্থ্রাইটিসের ধরন :
অবাক করার বিষয় হচ্ছে, আর্থ্রাইটিসের ১০০টিরও বেশি ধরন আছে। এর মধ্যে কিছু ধরন বেশ পরিচিত এবং ধীরে ধীরে বাড়ে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় অস্টিওআর্থ্রাইটিস।
অস্টিওআর্থ্রাইটিস : আমাদের দেশের এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অস্টিওআর্থ্রাইটিসকে সহজ বাংলায় বলা যায় হাঁটুর ব্যথা। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হাঁটুতে ক্ষয়ের কারণে এমনটা হয়ে থাকে। এতে হাঁটু ব্যথা করে, ফুলে যায়। স্বাভাবিক হাঁটা-চলা কঠিন হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন এই সমস্যা চলতে থাকলে অনেকের ক্ষেত্রে হাঁটু বেঁকে যেতে পারে।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস : এটি একটি অটোইমিউন বা প্রদাহজনিত রোগ। যার ফলে জয়েন্টে ব্যথা, ফোলাভাব ও জয়েন্ট শক্ত হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়। অর্থাৎ ইমিউন সিস্টেম যখন জয়েন্টের ক্ষতি করে তখনই রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস দেখা দেয়।
গাউট আর্থ্রাইটিস : একে বাংলায় গেঁটে বাত বলা হয়। শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে এই সমস্যা দেখা দেয়।
অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস আর্থ্রাইটিস : এটি মেরুদণ্ডে বেশি হয়। এই আর্থ্রাইটিসে মেরুদণ্ডের শেষ ভাগ বা কোমর আক্রান্ত হয়।
জুভেনাইল আর্থ্রাইটিস : কম বয়সে আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হলে তাকে জুভেনাইল আর্থ্রাইটিস বলে। শিশু বা ১৬ বছরের কম কিশোররা এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত।
কেন হয় আর্থ্রাইটিস?
বিভিন্ন কারণে আর্থ্রাইটিস হতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ হলো-
বয়স : বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শরীরের জয়েন্ট, হাঁটুতে ক্ষয় হয়। যা আর্থ্রাইটিসের কারণ হতে পারে।
ওজন: অতিরিক্ত ওজনের কারণে অস্থিসন্ধি, হাঁটুর ক্ষয় বেশি হয়। এই কারণেও আর্থ্রাইটিস হতে পারে।
পারিবারিক ইতিহাস : বাবা-মা বা বংশে কারো যদি আর্থ্রাইটিস থাকে, তাহলে পরবর্তী সময়ে সন্তানদেরও আর্থ্রাইটিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
আঘাত : কোনো কারণে অস্থিসন্ধিতে আঘাত পেলে তা আর্থ্রাইটিসের কারণ হতে পারে।
ইনফেকশন : অস্থিসন্ধিতে যদি ব্যাকটেরিয়াল বা ভাইরাল ইনফেকশন হয়, সেখান থেকে আর্থ্রাইটিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
ধূমপান : ধূমপান বা অন্যান্য তামাকজাতীয় পণ্য গ্রহণের অভ্যাস আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
এছাড়াও পঞ্চাশের বেশি বয়স্ক মানুষ, খেলোয়াড়, পেশীর অতিরিক্ত ব্যবহার হয় এমন পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি বেশি থাকে।
আর্থ্রাইটিসের লক্ষণ :
আর্থ্রাইটিস হলে জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধিতে ব্যথা হয়। এই ব্যথা অল্প হতে পারে, আবার মাঝারি বা অতিরিক্তও হতে পারে। আরও যে সমস্যাগুলো দেখা দেয় তা হলো-
১. অস্থিসন্ধি ফুলে যাওয়া। ২. অস্থিসন্ধি জমে যাওয়া। ৩. গতিশীলতা কমে যাওয়া। ৪. ত্বকের বিবর্ণতা। ৫. অস্থিসন্ধিতে তাপ বা উষ্ণতা অনুভব করাআর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা।
চিকিৎসার জন্য রোগীর ইতিহাস ও লক্ষণ জেনে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রথমে শনাক্ত করা হয় কোন ধরনের আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত। পরে চিকিৎসক প্রকারভেদ অনুযায়ী রোগীকে ওষুধ দিয়ে থাকেন।
যেকোনো আর্থ্রাইটিসে ব্যথা থাকেই। তাই প্রাথমিক অবস্থায় রোগীকে ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া হয়। ব্যথা না কমলে অনেক সময় ডিজিজ মডিফাইং ওষুধ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ব্যায়াম শিখিয়ে দেওয়া হয়। ওষুধ ও ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে অনেকের আর্থ্রাইটিস ভালো হয়ে যায়।
আর্থ্রাইটিসের কারণে যদি অস্থিসন্ধি বেঁকে যায়, নিজস্ব স্থান থেকে সরে যায় এবং ওষুধ ও থেরাপি কাজ না করে, সেক্ষেত্রে কারো কারো ক্ষেত্রে আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসায় সার্জারির প্রয়োজন হয়। হাতের আঙ্গুল, হাঁটু বেঁকে গেলে প্রতিস্থাপনের সার্জারি করা হয়।
আর্থ্রাইটিস প্রতিরোধে করণীয় :
আর্থ্রাইটিসের সঙ্গে লড়তে অবশ্যই স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে হবে। শরীরের ওজন যেন না বাড়ে সেদিকে খেয়াল রাখুন। খাদ্যতালিকায় সুষম খাবারের পাশাপাশি এমন খাবার রাখুন যা হাড় মজবুত করতে সাহায্য করবে।
আর্থ্রাইটিসে অস্থিসন্ধি ও হাড়ের ক্ষয় রোধে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। ভিটামিন ডি, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, ওমেগা থ্রি সমৃদ্ধ খাবার, টক জাতীয় ফল, পেস্তা বাদাম, কাঠবাদাম, শিমের বীজ, সয়াবিন খাওয়া ভালো। এছাড়াও বিশেষায়িত খাবার যেমন বায়ো-একটিভ সমৃদ্ধ ফাংশনাল ফুড আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।
রেড মিট অর্থাৎ গরু ও খাসির মাংস এড়িয়ে চলতে হবে। বাঁধাকপি, পালং শাক, গাজর, টমেটো, ডাল জাতীয় খাবার কম খেতে হবে। মিষ্টি জাতীয় খাবার না খাওয়াই ভালো। কফি জয়েন্টের ক্ষতি করে, তাই এটি কম খাওয়ার চেষ্টা করবেন। ছাড়তে হবে ধূমপান বা অ্যালকোহল গ্রহণের অভ্যাস।
আর্থ্রাইটিস প্রতিরোধে জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধির যত্ন নিন। জয়েন্টে যাতে কোনোভাবে আঘাত না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখুন। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করা, জয়েন্টের ব্যায়াম করুন। সিঁড়ি বেয়ে অতিরিক্ত ওঠা-নামা করবেন না।
প্রসঙ্গত, আর্থ্রাইটিসের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর ১২ অক্টোবর ‘বিশ্ব আর্থ্রাইটিস দিবস’ পালন করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ অক্টোবর থেকে আর্থ্রাইটিস দিবসের সূচনা হয়।
মন্তব্য করুন