বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনে হতাহতদের চিকিৎসায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসকের একদিনের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক।
ওই চিকিৎসক বলেন, ‘১৯ জুলাই (শুক্রবার) অনকল ডিউটি থাকা সত্ত্বেও সকাল ১০টায় ব্যাগে কিছু জামা কাপড় নিয়ে প্রয়োজনে সারা রাত থাকার প্রস্তুতি নিয়ে হাসপাতালে চলে যাই। শুক্রবার জুমার নামাজ পরবর্তী জমায়েত হতে কর্মসূচি এবং তৎপরবর্তী সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা আঁচ করছিলাম। কিন্তু সকাল সাড়ে ১০টা হতে গুলিবিদ্ধ রোগী আসতে শুরু হলো। পরপর অনেকগুলো রোগী পেলাম রামপুরা ও বাড্ডা এলাকায় গুলিবিদ্ধ। কেউ বলছে পুলিশের গুলি, কেউ ছাত্রলীগ, কেউ বিজিবি, কেউ সমাবেশে মিছিলে, আবার কেউ কেউ বলছে রাস্তায়, দোকানে, অটো, সিএনজিতে।’
তিনি বলেন, ‘দুপুর হতে আসতে লাগল যাত্রাবাড়ী শনির আখড়া এলাকা হতে গুলিবিদ্ধ হয়ে। দুপুরের পর কিছু আসতে লাগল মোহাম্মদপুর-বসিলা থেকে। লক্ষণীয় বিষয় ছিল এর মাঝে ছাত্রের সংখ্যা খুবই নগণ্য বা এক-দুজন। অপরাহ্ণ পরবর্তী রোগী আরও বেশি হবার আশঙ্কায় অপারেশন ফাঁকে ফাঁকে অপারেশন চালিয়ে নিচ্ছিলাম। ৩টি অপারেশন শেষ করে সন্ধ্যা ৭টার দিকে চার নম্বর রুমে রোগীও এটেনডেন্টের অতিরিক্ত চাপ থাকায় ক্রাউড কন্ট্রোলে নিজেই গেটে দাঁড়িয়ে যাই। আনসারদের গাইড করতে থাকি One patient one attendant. রেসিডেন্টদের গাইড করতে থাকি How to dispose patient rapidly.’
সন্ধ্যার পর থেকেই রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সাড়ে ৭টার পর থেকে রোগীর সংখ্যা এবং আসার হার এত বেড়ে গেল যে কোথা থেকে আসছে, কী ঘটনা জিজ্ঞাসা করার ফুসরত পেলাম না। ক্রমেই বুঝতে পারলাম পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে, আমাদের বিদ্যমান জনবল, স্থান সংকুলান, লজিস্টিকস, সামর্থ্য সব অতিক্রম করে যাচ্ছে। অনেকেই জানিয়ে রেখেছিল আহতদের চিকিৎসা সেবা দিতে আগ্রহী। ক্যাজুয়ালটির ডাক্তার ব্যতিত অন্যদের নিরুৎসাহিত করেছিলাম কারণ অন্যরা ঢালাওভাবে আসলে চার নম্বর রুমে স্থান সংকুলান সমস্যা হবে কিন্তু স্কিলড সার্ভিস হবে না, অব্যবস্থাপনা বেশি হবে। তাই অধ্যাপক মাহফুজ স্যার ও সহকারী অধ্যাপক আশরাফ ভাই দুজনকে ফোন করে আসার অনুরোধ করলাম যারা আসলে চাপ মোকাবিলায় সহায়ক হবে।’
তিনি বলেন, ‘রাত ৮টা নাগাদ স্রোতের মতো গুলিবিদ্ধ রোগী একের পর এক ট্রলিতে করে, দুই তিনজনে ঝুলিয়ে নিয়ে চার নম্বর রুমে ঢুকাতে লাগল। আনসাররা ক্রাউড কন্ট্রোল ভুলে গিয়ে বোকার মতো তাকিয়ে রইল। মুহূর্তেই চার নম্বর রুমের সব বেড, ফ্লোর রোগীতে এটেনডেন্টে সম্পূর্ণ ভরে গেল। সেখানে চিকিৎসা দেওয়া তো দূরের কথা রুমে আমার ঢোকার জো টুকুও নেই। ভাবলাম এই মুহূর্তে রুমে ঢুকেও তো কিছুই করতে পারব না।’
স্রোতের মতো রোগী আসছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাহিরে ইমার্জেন্সি গেট এবং তার বাহির হতে শোরগোল করে স্রোতের মতো রোগী, রোগীর লোকজনসহ তীব্র গতিতে রোগী নিয়ে চার নম্বর রুমে, রুমের বাইরে এসে ভরে যাচ্ছে এবং আসছে তো আসছেই। রুমে ঢুকাতে না পেরে আহাজারি, হতাশা, চিৎকার। যা অবর্ণনীয়। এবার মনে হচ্ছে, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী বা মোহাম্মদপুর নয়, ইমারজেন্সি গেটের বাইরেই ইউনিভার্সিটি মাঠে কোনো সম্মুখ যুদ্ধ হচ্ছে। যেখানে ব্রাশ ফায়ার হচ্ছে এবং যে যেভাবে পারে গুলিবিদ্ধ রোগী বহন করে চার নম্বর রুমে নিয়ে আসছে। কোনো যুদ্ধেও হয়তো এত রোগী একসঙ্গে কোনো হাসপাতালে আসেনি। প্রায় সবই গুলিবিদ্ধ। বুকে, পেটে, মাথায়, পায়ে সবখানে। বেশিরভাগই মৃত্যু পথযাত্রী। অনেকেই মৃত। গুলি বুকের সামনে দিয়ে ঢুকে পেছনে, পেছন থেকে ঢুকে সামনে বড় ছিদ্র হয়ে বের হয়ে যাওয়া। গল গল করে রক্তপাত হচ্ছে। গুলি পেটের সামনে থেকে পেছনে বা একদিক দিয়ে ঢুকে অন্যদিকে বড় ক্ষত হয়ে নাড়িভুঁড়িসহ বের হওয়া। মাথায় সামনে গুলি ঢুকে পেছনে মগজসহ বের হওয়া। আঘাতের ধরন দেখে মনে হচ্ছিল, এগুলো কোনো সাধারণ সন্ত্রাসী, পুলিশ বা অকেশনাল অস্ত্রধারির কাজ নয় It is a brutal murder. নির্দয়, নৃশংস, পেশাদার কিলার যাদের লক্ষ্য হচ্ছে যত বেশি লোক হত্যা করা যায়। মনে হচ্ছিল অচেনা অমানবিক দানবীয় কোনো শক্তি হত্যা মিশনে নেমেছে।’
ওই চিকিৎসক বলেন, ‘অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছি কয়েক মুহূর্ত। চার নম্বর রুমে ঢুকার জো নেই, চিকিৎসা দেওয়া তো দূরের কথা। ক্ষণিকের জন্য মনে হলো এতবড় বিপর্যয় সামলানোর সামর্থ্য এই মুহূর্তে আমার বা আমার টিমের নাই। আমার টিমকে নিয়ে এখান থেকে কোনোভাবে বের হয়ে যাই। ডিরেক্টর স্যারকে বলি স্যার আমাদের আর করার কিছু নাই। পরক্ষণেই মনে হলো এটা অসম্ভব চিন্তা। এর দ্বিগুণ রোগীও যদি আসতে থাকে তাও আমাদের প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। The show must go on.’
তিনি বলেন, ‘চার নম্বর রুমে ঢুকার চিন্তা বাদ দিলাম। ভাবলাম ১৫ থেকে ২০ মিনিট ওরা যা পারে করুক বা না করুক আমাকে বিকল্প একটা ব্যবস্থা করতে হবে। গেলাম সাত নম্বর সার্জারি অবজারভেশন রুমে যেখানে আছে তিনটা বেড, খালি জায়গায় আরও দুই ৩টা বেড দেওয়া যাবে। একজন মাত্র নার্স ডিউটিতে আছে। সঙ্গে সঙ্গে ওখানে দাঁড়িয়ে সালমা ম্যাডামকে ফোন দিলাম। ম্যাডাম স্রোতের মতো গুলিবিদ্ধ রোগী আসছে। আমাদের ক্যাপাসিটি অ্যাক্সিড করে গেছে। এই রুমে রোগী দেওয়া লাগবে। ডাক্তার, নার্স, লজিস্টিকস লাগবে। তখনই ম্যাডাম এডমিশন ডিউটিতে থাকা পাঁচজন ডাক্তার পাঠালেন। ডিরেক্টর স্যার ও ইনচার্জ সাহেবকে বলে নার্স ও লজিস্টিক ম্যানেজ করে ফেলা হলো মুহূর্তেই। ৭ নম্বর রুমে রোগী দিতে বলতে না বলতেই ভরে গেল, তিন বেডে তিনজন, ফ্লোরে তিনজন। ট্রলিতে, ফ্লোরে বুকে গুলিবিদ্ধ রোগীর রক্তের স্রোতে ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে। এখনই অপারেশন করা দরকার, রক্তের প্রয়োজন, সঙ্গে লোক নেই, অসহায় অবস্থা। অন্য রোগীগুলোর অবস্থাও তাই। একটার গ্রাস্পিং হচ্ছে, একটা মৃত বলে মনে হচ্ছে। মাহফুজ স্যার এসে দায়িত্ব নিলেন সাত নম্বর রুমের। বাইরে আরও রোগী ঢুকতে পারছে না। দ্রুত ডেথ ডিক্লেয়ার করে ডেড বডি সরাতে হবে, রোগী ভর্তি দিয়ে বেড খালি করতে হবে। ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ড অলরেডি পরিপূর্ণ ফ্লোরসহ। আবার ম্যাডামকে ফোন দিলাম, সার্জারি এডমিশন ইউনিটে রোগী দিতে হবে। দাও, ম্যাডাম বললেন।’
ওই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘একটু পরে ম্যাডামকে আবার ফোন দিলাম। ম্যাডাম, সার্জারি ৬টা ইউনিটেই রোগী দিতে হবে, সেখানে ডাক্তার নার্স বাড়াতে হবে, ইউনিট প্রধানদের বলে ডাক্তার যারা কাছে আছে, তারা যেন চলে আসে। আমি বলে দিচ্ছি তুমি ভর্তি দাও, ম্যাডাম বললেন। ম্যাডাম আরও জানালেন, ‘আমি ৩টা ইমারজেন্সি ওটি খুলে দিতে বলেছি। আমার এডমিশন ইউনিটের ডাক্তারদের কাছে লাগাও।’ ইতোমধ্যে আশরাফ ভাই ঝুঁকি নিয়ে চলে আসলেন। আরও আসলেন ফরিদ ভাই, কাফি ভাই, শিশির। মাহফুজ স্যারসহ তাদের নেতৃত্বে তিন ওটিতে ৩টা পেশেন্ট অপারেশন শুরু করে দিলেন। আমার মেডিকেল অফিসাররাসহ রেসিডেন্টরা সকাল থেকে টানা কাজ করে যাচ্ছে। ডিরেক্টর স্যার, প্রিন্সিপাল স্যার, ভাইস প্রিন্সিপাল স্যার সশরীরে এসে পরিস্থিতি দেখে গেলেন। জরুরি রক্তদানের জন্য মাইকিং করা হলো। সন্ধানী রক্তদান কর্মসূচি আয়োজন করে ১০০ ব্যাগেরও বেশি রক্ত সংগ্রহ করে ফেলল। আরএস আলাউদ্দিন ভাই আমাদের নিয়ে গেলেন বার্ন ইউনিটের নিচ তলায়। ৮টা অবজারভেশন বেড খালি করা হলো। ডাক্তার নার্স বাড়ানো হলো। রাত ১১টায় কারফিউ ঘোষণা আসার আগ পর্যন্ত কয়েকটি ঘণ্টা যেন কয়েক মুহূর্তে কেটে গেল। কোনোরকম পূর্ব প্রস্তুতি পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া সীমিত লজিস্টিকস ও অপ্রতুল জনবল, একদল তরুণ ও রেসিডেন্ট ডক্টরদের নিয়ে হার না মানা অক্লান্ত পরিশ্রম করে গুলিবিদ্ধ মুমূর্ষু রোগীদের বাঁচানোর জন্য যে সংগ্রাম ক্যাজুয়ালটি টিম সেদিন করেছে জানি না সেটাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যাবে। কারফিউ ঘোষণা আসার পর সাড়ে ১১টার পর থেকে রোগীর ফ্লো কিছুটা কমে আসে। যদি কারফিউ না দেওয়া হতো এবং এরকম গতিতে রোগী আসা আরও কয়েক ঘণ্টা অব্যাহত থাকত তবে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের সবগুলো বিভাগ খুলে দিলেও সমস্ত বেড হয়তো রোগীতে ভরে যেত।’
তিনি বলেন, ‘এরপর সারা রাত প্রত্যেকটি ওটিতে অপারেশনের তদারকি করছিলাম। এরপর ঘণ্টাখানেক বিশ্রামের পর ভোর ৬টায় দেখলাম ১০টি অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে। চেস্ট ড্রেইন দেওয়া হয়েছে ২০টির অধিক। মাইনর অপারেশন শতাধিক। তখনো ২২টি জরুরি ল্যাপারোটমি অপারেশন বাকি আছে। ইমতিয়াজ ফারুক স্যারকে ফোন করে জানালাম। আমি ব্যবস্থা করছি, স্যার জানালেন। সব রুটিন অপারেশন বাতিল করে ৫টি জেনারেল অপারেশন থিয়েটারেও অপারেশন শুরু হলো। ততক্ষণে সার্জারি ৬টি ইউনিটের ডাক্তাররা এসে যোগ দিল। COT, EOT, GOT মিলে ১০টি ওটিতে ১০টি টিম একযোগে অপারেশন শুরু করল। দুপুর ২টার মধ্যে সার্জারি বিভাগের সর্বাত্মক সহযোগিতায় জরুরি জীবন রক্ষাকারী ল্যাপারোটমি অপারেশনগুলো শেষ করে ফেলতে আমরা সমর্থ হই। এই ল্যাপারোটমিগুলো সময়মতো না করতে পারলে আরও অনেকগুলো জীবন আমরা হয়ত হারাতাম। সবার সহযোগিতায় এরকম একটা মহাদুর্যোগ আমরা মোটামুটি সফলভাবে সামাল দিতে সমর্থ হয়েছি।’
মন্তব্য করুন