রাত ১১টা। হাসপাতালের কেবিনের বাইরে উদ্বিগ্ন কয়েকজন স্বজন দাঁড়িয়ে আছেন। ভেতরে এক রোগীর জীবন-মরণ সংকট। তার শরীরে রক্তের প্রয়োজন, কিন্তু রমজান মাস হওয়ায় রক্তদাতা পাওয়া যাচ্ছে না। অনেককে ফোন করা হয়েছে, কিন্তু সারাদিন রোজা রেখে কেউ এখনো এগিয়ে আসতে পারছেন না।
হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে কিছু সংরক্ষিত রক্ত থাকলেও চিকিৎসক তা ব্যবহারে দ্বিধান্বিত। কারণ, মজুদ করা রক্তের গুণগত মান নিশ্চিত না হলে তা রোগীর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। অন্যদিকে, রোগীর অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে। স্বজনদের মধ্যে একজন হতাশ কণ্ঠে বললেন, "রমজানে কি তবে রক্ত পাওয়া যাবে না? রোজা কি আমাদের এই মানবিক দায়িত্ব থেকে বিরত রাখে?"
রমজান মাস মুসলমানদের জন্য আত্মসংযম, ইবাদত ও ত্যাগের মাস। এই সময়ে দীর্ঘ ১২-১৪ ঘণ্টা পানাহার ও শারীরিক চাহিদা থেকে বিরত থাকতে হয়, যা শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য একটি বড় পরীক্ষা। তবে, এই সময়ে রক্তদান করা নিয়ে অনেকের মধ্যে দ্বিধা থাকে। শান্তির ধর্ম ইসলাম কি বলে এই ক্ষেত্রে?
ইসলামে মানবতার সেবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি একটি প্রাণ বাঁচায়, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে বাঁচাল” (সূরা মায়েদা: ৩২)। রমজান সংযমের মাস হলেও, এটি অন্যের উপকারে আসার সুযোগও এনে দেয়। অনেক ইসলামি স্কলারদের মতে, রক্তদান রোজা ভঙ্গ করে না যদি তা দুর্বলতা সৃষ্টি না করে। তবে, দুর্বলতা অনুভব করলে বা শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে গেলে ইফতারের পর রক্তদান করা উত্তম।
বৈজ্ঞানিক দিক থেকে কোনও ব্যাখ্যা রয়েছে কি? রক্তদান একটি নিরাপদ ও মানবিক কাজ, তবে এটি করার জন্য শরীরকে প্রস্তুত রাখা জরুরি। রমজানে রক্তদানের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা উচিত: ১. রক্তদানের সময়: সেহরির পর বা ইফতারের ২-৩ ঘণ্টা পর রক্তদান করা উত্তম। কারণ, ইফতারের পর শরীরে পানিশূন্যতা কমে আসে এবং শরীর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। ২. পর্যাপ্ত পানি পান: রক্তদানের আগে ও পরে শরীরে পানিশূন্যতা রোধের জন্য ইফতার ও সেহরিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ও তরল খাবার গ্রহণ করা জরুরি। ৩. পুষ্টিকর খাবার: রক্তদানের পর শক্তি ফিরে পেতে প্রোটিন ও আয়রন সমৃদ্ধ খাবার যেমন খেজুর, দুধ, ডিম, মাছ ও শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। ৪. শরীরের অবস্থান: রক্তদানের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া উচিত যাতে মাথা ঘোরা বা দুর্বলতা অনুভব না হয়।
রক্তদাতাদের বিষয়ে রোগীর স্বজনদের কি করনীয়? রমজানে রক্তদাতার সংখ্যা কমে যায়, ফলে রোগীদের জন্য রক্ত সংগ্রহ করা কষ্টকর হয়ে ওঠে। তাই রোগীর স্বজনদের উচিত: • রক্তদাতাদের যথাযথ সম্মান জানানো এবং তাদের জন্য উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করা। • ইফতারের পর বা রাতের সময়ে রক্তদানের জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের উৎসাহিত করা। • হাসপাতাল ও ব্লাড ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে পূর্বপরিকল্পিতভাবে রক্ত সংগ্রহ করা।
হাসপাতাল গুলোর কি করা উচিত? রমজানে রক্ত সংকট মোকাবিলার জন্য হাসপাতাল ও ব্লাড ব্যাংকগুলোকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে: ১.পূর্বপরিকল্পিত ক্যাম্পেইন: রমজানের শুরুতেই সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়ে আগেভাগে রক্ত সংগ্রহ করতে হবে। ২.ইফতারের পর রক্তদান কর্মসূচি: ইফতারের পর রক্তদানের সুবিধা দিতে হবে যাতে রক্তদাতারা স্বস্তিতে রক্তদান করতে পারেন। ৩.স্টক ম্যানেজমেন্ট: জরুরি রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় রক্তসংগ্রহ ও সংরক্ষণের বিশেষ পরিকল্পনা নিতে হবে।
রমজান আত্মসংযম ও মানবসেবার মাস। রক্তদান এক মহৎ ইবাদত, যা একজন মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে। শরীর সুস্থ থাকলে ইফতারের পর বা সেহরির আগে রক্তদান করা যেতে পারে, যাতে রক্তের অভাবজনিত দুর্যোগ এড়ানো যায়। রক্তদানকারীদের সচেতনতা ও হাসপাতালগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ এই চাহিদা মেটাতে সহায়ক হবে।
ডা. আশরাফুল হক, সহকারি অধ্যাপক, রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ
মন্তব্য করুন