বিশ্বজুড়ে বাড়ছে এমপক্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। মাঙ্কিপক্স নামে এ ভাইরাসটি পূর্বে পরিচিত ছিল। এমপক্স আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে ছড়ায়। এ ছাড়াও সঙ্গম, ত্বকের সংস্পর্শ, কথা বলা বা শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমেও এটি ছড়াতে পারে। আফ্রিকা, ইউরোপের পর এবার এশিয়ার পাকিস্তানে সর্বশেষ তিনজন রোগী শনাক্ত হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও) এ ভাইরাস নিয়ে সতর্কতা জারি করেছে। কেননা ছোঁয়াচে এ এমপক্স দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
কী এই এমপক্স?
এই ভাইরাসটি পূর্বে মাঙ্কিপক্স নামে পরিচিত ছিল। আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে ছড়িয়ে পড়ে এমপক্স। কথা বলা বা শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমেও এটি ছড়াতে পারে। ফ্লুর মতো উপসর্গ ছাড়াও এতে পুঁজ ও ক্ষত সৃষ্টি হয়। এর উপসর্গ হিসেবে সংক্রমণের ৬ থেকে ১৩ দিন পর সাধারণত মাথাব্যথা, জ্বর, ফুসকুড়ি বা ঘা এবং মাংসপেশিতে ব্যথা দেখা দেয়। বেশিরভাগ সময় প্রভাব সামান্য হলেও মৃত্যুও হতে পারে এ রোগে। আক্রান্ত হওয়া ১০০ জনের মধ্যে এই ভাইরাসে মৃত্যু হয় গড়ে চারজনের।
কেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে?
দেশ ও দাতা সংস্থাগুলোকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে উদ্বুদ্ধ করতে ডব্লিওএইচও-এর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণা সংক্রামিত এলাকায় পরীক্ষা, টিকা এবং ওষুধ পাওয়া সহজ করে। এ ছাড়াও এটি ভাইরাস নিয়ে বিদ্যমান কুসংস্কার দূর করার লক্ষ্যে সচেতনতামূলক প্রচারণা বাড়াতে সাহায্য করে।
তবে, আগের ঘোষণা মোতাবেক বিশ্বব্যাপী মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আফ্রিকার সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) পরিচালক ডা. জিন কাসেয়া জানান, এ ঘোষণা আফ্রিকার সংস্থা ও সংস্থাগুলোকে সিদ্ধান্তমূলকভাবে দ্রুত কাজ করতে উৎসাহ জোগাবে। আফ্রিকায় দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া এ রোগের জন্য খুব কমই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তাই আফ্রিকার আন্তর্জাতিক অংশীদারদের কাছে তিনি সাহায্য চেয়েছেন।
লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক মাইকেল মার্কস বলেন, বর্তমানে এ রোগের নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলো কাজ না করায় আরো সাহায্যের দরকার। সাহায্যের প্রয়োজনে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হবে।
কোথায় ঘটছে সংক্রমণ?
এখন পর্যন্ত আফ্রিকার ৩৪টি দেশে এমপক্স ভাইরাসের সংক্রমণ নথিভুক্ত হয়েছে। বিভিন্ন দেশেও এই ভাইরাসটিকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়েছে। ভাইরাসটি মূলত কঙ্গো থেকেই আশপাশের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে। ২০২৪ সালের শুরু থেকে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে সংক্রমণ হয়েছে ১৪ হাজারেরো বেশি এবং মৃত্যু হয়েছে ৫২৪ জনের। যেখানে আগে কখনো সংক্রমণ ঘটেনি সেখানেও রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এর মধ্যে আছে বুরুন্ডি, কেনিয়া, রুয়ান্ডা এবং উগান্ডাও।
কেনো বাড়ছে সংক্রমণ?
ক্লেড-১ এবং ক্লেড-২ হলো এমপক্সের দুটি প্রধান ধরন। ক্লেড ১ আবার দুই রকমের- ক্লেড ১-এ এবং ক্লেড ১-বি। ক্লেড ১-বি ভেরিয়েন্ট এর দেখা মিলেছে কঙ্গোয়। এ ছাড়াও কেনিয়া, রুয়ান্ডা ও উগান্ডায়ও এটি দেখা গেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সংক্রমণ বাড়াচ্ছে এই নতুন ভ্যারিয়েন্টটি। সাধারণত আগে সংক্রমিত বুশমিট খেয়ে ছড়াতো ক্লেড ১। কিন্তু এখন মানুষের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে ক্লেড ১-বি , যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে বিশেষ করে ছড়াচ্ছে এটি। এ ছাড়াও বিছানা বা তোয়ালের মাধ্যমে কিংবা শারীরিক ছোয়ায়ও ছড়াতে পারে এটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এমপক্স প্রধান ড. রোসামুন্ড লুইস বলেছেন, এটি বেশি সংক্রামক কি না তা অজানা হলেও, এটি সহজে ছড়িয়ে পড়ছে। ক্লেড ১-এ ভেরিয়েন্ট ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো এবং সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকেও পাওয়া গেছে। ডব্লিওএইচও আরও জানিয়েছে, ক্যামেরুন, লাইবেরিয়া, আইভরি কোস্ট, নাইজেরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায়ও ক্লেড-২ পাওয়া গেছে।
কীভাবে ভাইরাসটি ছড়াচ্ছে এবং শিশুরা কেন সহজে আক্রান্ত হচ্ছে?
শিশুদের মধ্যে এমপক্স ভাইরাসটি বেশি দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে,রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়ায় শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে আছে। এ ছাড়া, শিশুরা বেশি শারীরিক সংস্পর্শে আসে এবং নিজেরা অনেক সময় সুরক্ষা ব্যবস্থা নিতে পারে না। ফলে তারা বেশি সংক্রমিত হতে পারে।
সংক্রমিত মানুষের মাধ্যমে ভাইরাসটি বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। দূরপাল্লার একজন ট্রাকচালকের মধ্যে এমপক্স শনাক্ত করেছেন কেনিয়ার কর্মকর্তারা। যিনি তানজানিয়া, রুয়ান্ডা এবং উগান্ডায়ও ছিলেন। এ ছাড়া ভাইরাসটি যৌনসম্পর্কের মাধ্যমেও অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। যৌনকর্মীরা শুরুর দিকে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল।
২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে এমপক্স ছড়িয়ে পড়ায় সমকামী এবং উভয়কামী পুরুষরা প্রধানত আক্রান্ত হয়েছিল। তবে কঙ্গোতে ১৫ বছরের নিচে ৭০ শতাংশ শিশু ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে মৃত্যু ঘটছে ৮৫ শতাংশের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়ায় এবং পুষ্টির অভাব থাকায় তাদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। গুটিবসন্তের টিকা নেওয়ায় বয়স্করা কিছু সুরক্ষা পেতে পারেন। সেভ দ্য চিলড্রেনের কঙ্গো পরিচালক গ্রেগ রাম উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, শরণার্থী শিবিরগুলোতে থাকা শিশুরা বেশি শঙ্কায় আছে— যেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অন্তত তিন লাখ ৪৫ হাজার শিশু বসবাস করছে।
ভ্যাক্সিন কি আছে?
হ্যাঁ, এই রোগের ভ্যাক্সিন বা টিকা আছে, তবে মূল সমস্যা এটি সরবরাহ করতে পারায়। আফ্রিকার সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন সংস্থা মাত্র দুই লাখ ডোজের সরবরাহ পেয়েছে। যেখানে প্রয়োজন ছিল ১০ মিলিয়ন ডোজের। পরীক্ষার এবং চিকিৎসা অভাবেও সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
এখনো পর্যালোচনাধীন আছে টিকাদানের পরিকল্পনা। তবে সংক্রমিত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা রোগী এবং এইচআইভি পজিটিভ ব্যক্তিদের মতো ঝুঁকিপূর্ণদের টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে আগে প্রাধান্য দেওয়া হবে। এ পর্যন্ত দুটি টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর আগে বিশেষ করে সমকামী পুরুষদের মধ্যে ভাইরাসটি ইউরোপ থেকে ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
২০২২ সালের জুলাই মাসে ডব্লিউএইচও জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। সেইসাথে ব্যাপক টিকাদান ও সুরক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ২০২৩ সালের মে মাসে তুলে নেওয়া হয় জরুরি অবস্থা।
মন্তব্য করুন