আমরা এমন একটি যুগে রয়েছি যখন মানুষ শুধু আরাম খুঁজছে। একইসঙ্গে রেস্টুরেন্টের সুস্বাদু খাবারের ওপর অত্যাধিক ঝোঁক এবং অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস মারাত্মকভাবে আমাদের শারীরিক ক্ষতি সাধন করছে। এই আরামপ্রিয়তা এবং অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসে আমরা ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হচ্ছি নীরব ঘাতক ফ্যাটি লিভারে।
পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বজুড়ে প্রায় ১১.৫ কোটি মানুষ ভুগছেন ফ্যাটি লিভারে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৩৫ কোটিতে। আর বাংলাদেশে প্রতি তিনজনে একজনের ফ্যাটি লিভার আছে।
গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষ ফ্যাটি লিভারে ভুগছে এবং এর মধ্যে প্রায় ১ কোটি মানুষ সিরোসিস বা লিভার ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। অথচ প্রায় ক্ষেত্রে শুধু খাদ্যাভ্যাস, হাঁটার অভ্যাস ও জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তন এবং ওজন কমানোর মাধ্যমে ফ্যাটি লিভার ও ন্যাশ প্রতিরোধ করা যায়।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা কার্বোহাইড্রেট-সমৃদ্ধ খাবার, বিশেষত ভাত বেশি গ্রহণ করছেন এবং সেই তুলনায় শারীরিক পরিশ্রম বা হাঁটা-চলাফেরা কম করছেন, তাদের ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া বাইরের খাবার গ্রহণ, দিনে পাঁচ ঘণ্টার ওপরে যাদের বসে থাকতে হয় এবং একই সঙ্গে কায়িক পরিশ্রম কম হয়, তাদেরও ঝুঁকি বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লিভার রোগজনিত মৃত্যু বিশ্বব্যাপী মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে পরিগণিত। লিভার সিরোসিস ও ক্যানসারের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে লিভারে চর্বি জমা। অতিরিক্ত চর্বি জমা হওয়ার কারণে যকৃতে যে প্রদাহ সৃষ্টি হয়।
ফ্যাটি লিভারের বিপজ্জনক পরিণতি হচ্ছে ন্যাশ (এসএএসএইচ)। নির্ণয়হীন ও নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় ফ্যাটি লিভার বিপজ্জনকভাবে ন্যাশের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই রোগ হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং শরীরে ইনসুলিন হরমোনের কার্যকারিতা কমে যাওয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও এই রোগের প্রাদুর্ভাব আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, ফ্যাটি লিভার এর চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। সারা বিশ্বে মাত্র দুটি ওষুধ দিয়ে এই রোগ প্রতিরোধে কাজ করা হচ্ছে। গবেষকরা আরও জানিয়েছেন, এই ফ্যাটি লিভার জনিত অসুস্থতায় সারা বিশ্বে প্রতিবছর ৮৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়।
ফ্যাটি লিভার এবং এর প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে গতকাল ১৩ জুন বিশ্বব্যাপী সপ্তম বারের মতো পালিত হয়েছে ‘গোল্ডেন ফ্যাটি লিভার দিবস-২০২৪’। এ বছরের দিবসের প্রতিপাদ্য হয়েছে—ACT NOW, SCREEN TODAY. বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি উদযাপিত হয়েছে।
দিবসটি উপলক্ষে গতকাল বুধবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ ‘কম খাই হাঁটি বেশি, ফ্যাটি লিভার দূরে রাখি’ বিষয়ক গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে।
গোলটেবিল আলোচনায় হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা কর্তৃক বাংলাদেশে ফ্যাটি লিভার রোগ প্রতিরোধে কিছু সুপারিশ তুলে ধরে—প্রত্যেক ব্যক্তির সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন এবং প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট করে হাঁটতে হবে। দড়ি লাফ ও সাইকেল চালানো শরীরচর্চার জন্য ভালো। দুধ, ফল, শাকসবজি খাওয়া বাড়ানো এবং চিনিযুক্ত খাবার, পানীয়, চকোলেট, আইসক্রিম, ফাস্ট ফুড এবং (ভাজা খাবার) ট্রান্স-ফ্যাটের পরিমাণ কমানোর মাধ্যমে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে ক্যালোরি গ্রহণ কমাতে হবে।
এ ছাড়াও, শরীরচর্চা বাড়ানো যায় এ রকম পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। দেশের প্রতিটি স্কুল ও প্রশাসনিক ওয়ার্ডে খেলার মাঠ রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং প্রতিটি শিশুকে খেলতে ও অন্যান্য শারীরিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে।
মন্তব্য করুন