প্রায় প্রত্যেক মানুষের সাধারণ একটি সমস্যা হলো ঘাড়ব্যথা। শুরুতে অনেকের এই ব্যথা হালকা থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি গুরুতর হয়ে ওঠে। ঘাড়ের এ ব্যথা কারও অল্প দিন থাকে, আবার কারও ক্ষেত্রে সেটি অনেক দিন স্থায়ী হয়। ঘাড়ে ব্যথা অনেক কারণে হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে আঘাত পাওয়া, রাতে বালিশে সঠিকভাবে না ঘুমানো কিংবা অতিরিক্ত স্ট্রেসে থাকা।
সাধারণত ঘাড়ের ব্যথা কমানোর জন্য আমরা ওষুধ খাই বা ব্যথা স্থানে মলম লাগাই। অনেকে আবার ঘরোয়া উপকরণও ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু ঘাড়ে ব্যথাকে সাধারণ ব্যথা মনে করে অবহেলা করলে অনেক সময়ে তা মারাত্মক রোগের আকার ধারণ করতে পারে। তাই এ প্রতিবেদনে আসুন আমরা জেনে নিই, ঘাড়ে ব্যথার কোন কোন রোগের সংকেত দিতে পারে এবং আপনাকে কখন ডাক্তার দেখানো উচিত।
ঘাড়ের ব্যথা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। তবে এর সঙ্গে আপনি যদি বমি বমি ভাব, ঘেমে যাওয়া, মাথাব্যথা, দুর্বলতার মতো অন্যান্য উপসর্গ অনুভব করেন, তাহলে বুঝতে হবে গুরুতর কোনো সমস্যা থাকতে পারে। তখন দেরি না করে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন।
ঘাড়ের পেশিতে টান
ঘাড়ের পেশিতে টান লাগার কারণে অনেক সময় ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে। ভুল অভ্যাসের কারণে ঘাড়ের পেশিতে টান লাগতে পারে। যেমন : ভুলভাবে বসা, শোয়া বা কাজ করা, বেশি সময় ধরে এক জায়গায় কাজ করা, ঘুমের সময় বালিশে ঘাড় ঠিকভাবে না রাখা এবং ব্যায়ামের সময় ঘাড়ে অতিরিক্ত ঝাঁকুনি লাগা।
দুশ্চিন্তা
দুশ্চিন্তা ও বাড়তি কোনো কিছুর চাপে অস্বস্তি অনুভবের কারণে আপনার এই ব্যথা হতে পারে।
আঘাত কোনো কারণে আঘাত পেলে ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে। যেমন : পড়ে যাওয়া, গাড়ি দুর্ঘটনা এবং খেলাধুলার বিভিন্ন আঘাতে ঘাড় অধিকতর ঝুঁকিতে থাকে। এ ছাড়া ঘাড়ের হাড় (সারভাইকাল কশেরুকা) ভেঙে গেলে মেরুদণ্ডও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আবার হঠাৎ মাথার অসাবধানতাবশত ঝাঁকুনি থেকে, ঘাড়ের আঘাত থেকে ঢ়ধৎব সাধারণত হুইপ্ল্যাশ বা কশাঘাত বলা হয়।
হার্ট অ্যাটাক হার্ট অ্যাটাক হলে কিংবা রক্তচাপ অনেক বেশি বেড়ে গেলে ঘাড়ব্যথা হতে পারে। এর সঙ্গে অন্যান্য উপসর্গও দেখা দেয়, যেমন : হাঁপানি, ঘাম, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, বাহু বা চোয়াল ব্যথা। এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে হাসপাতালে যেতে হবে।
মেনিনজাইটিস মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডকে ঘিরে থাকে এক ধরনের পাতলা টিস্যু। এই পাতলা টিস্যুতে জীবাণুর সংক্রমণ বা প্রদাহকে মেনিনজাইটিস বলে। এর লক্ষণগুলো হলো মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব বা বমি, জ্বর। তাই কারও যদি এসব লক্ষণ থাকে, তবে বিলম্ব না করে দ্রুতই চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
টরটিকালিস এটি ঘাড়ের মাংসপেশির সঙ্গে জড়িত। কোনো প্রকারের ক্ষতি অথবা রক্ত সঞ্চালন প্রভাবিত হওয়ার কারণে এতে সমস্যা হতে পারে। এ সমস্যার কারণে অনেকেই ঘুম থেকে উঠে ঘাড় ঘোরাতে পারেন না। অনেক সময় এ সমস্যা গভীর রোগের লক্ষণ হতে পারে। ফলে টিউমার ইনফেকশন এবং অন্যান্য সমস্যার মুখে পড়তে হতে পারে।
ব্রেকিয়েল প্লেক্সাস ব্রেকিয়েল প্লেক্সাস নার্ভের একটি নেটওয়ার্ক। স্পাইনাল কর্ড থেকে নিয়ে কাঁধ, হাত, বাহুতে সিগন্যাল পাঠায়। ঘাড়ে ব্যথার কারণে যখন এর প্রভাব প্লেক্সাসের ওপর পড়ে, তখন ব্যথা হতে শুরু করে। ব্রেকিয়েল চোট লাগার সবচেয়ে কমন কারণ হলো অ্যাক্সিডেন্ট বা খেলাধুলার সময় দৌড়ানো।
কিছু কিছু রোগের কারণে ঘাড় ও তার আশপাশের পেশিগুলো দুর্বল হয়ে যায়। এতে ঘাড়ের হাড়ের ওপর মাথার ওজনের চাপ বেশি পড়ে। যেমন :
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা বাত : এই রোগে ব্যথা, হাড়ের জয়েন্ট ফুলে যাওয়া এবং হাড়ের অস্বাভাবিকতা হয়। ঘাড় বা এর আশপাশে এগুলো হলে ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে।
অস্টিওপরোসিস : এতে হাড় দুর্বল হয় এবং ছোট ছোট ফাটল হতে পারে। অস্টিওপরোসিস প্রায়ই হাতে বা হাঁটুতে ঘটে, তবে এটি ঘাড়েও হতে পারে; যার ফলে ব্যথা সৃষ্টি হতে পারে।
স্পন্ডিলাইটিস : আপনার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সার্ভিক্যাল ডিস্ক ক্ষয়ে যেতে পারে। এটি স্পন্ডিলাইটিস বা ঘাড়ের অস্টিওআর্থ্রাইটিস নামে পরিচিত। এটি কশেরুকাগুলোর মাঝে জায়গা কমিয়ে দেয় এবং জয়েন্টগুলোতে চাপ দেয়।
স্লিপড ডিস্ক : যে কোনো ট্রমা বা আঘাত থেকে যখন কশেরুকার একটি ডিস্ক বেরিয়ে আসে, তাতে মেরুদণ্ডের ওপর চাপ পড়তে পারে। একে হার্নিয়েটেড সার্ভিক্যাল ডিস্ক বলা হয়, যা ফেটে যাওয়া বা স্লিপড ডিস্ক নামেও পরিচিত।
স্পাইনাল স্টেনোসিস : এ রোগের ফলে মেরুদণ্ড সরু হয়ে যায় এবং এতে চাপ পড়ে। আর্থ্রাইটিস বা অন্যান্য অসুস্থতাজনিত কারণে অথবা দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ থেকেও হতে পারে।
এ ছাড়া ঘাড়ের চামড়ার ওপরে বা ভেতরে ফোড়া, টিউমার বা মেরুদণ্ডের ক্যান্সারের কারণেও ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে।
যেসব কাজ করলে ঘাড় নড়াচড়া হয়, সেসব কাজ বন্ধ করে দিতে হবে। ভ্রমণের সময় যদি ঘাড়ে ঝাঁকি লাগে, তাহলে সেই ভ্রমণও বন্ধ রাখতে হবে। আর যারা অফিস করেন, কিছুদিন তাদের অফিস করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ঘাড়ের অসংগত নড়াচড়া রোধ করতে সার্ভাইক্যাল কলার ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রথম কিছুদিন ঘুমের সময়ও সার্ভাইক্যাল কলার পরে থাকা ভালো। এতে ঘুমের মধ্যে অসাবধানতাবশত ঘাড়ের নড়াচড়া প্রতিহত করা যায় ।
ঘুমানোর সময় ঘাড়টাকে চিত হয়ে কিংবা স্বাভাবিক অবস্থানের চেয়ে ১০-১৫ ডিগ্রি সামনের দিকে বাঁকিয়ে ঘুমানো উচিত। একটি স্বাভাবিক আকৃতির বালিশে ঘাড় সামনের দিকে বেশি বাঁকিয়ে থাকে। তাই ঘুমানোর সময় এসব বালিশ পরিহার করতে হবে। ঘাড়ের মেরুদণ্ডকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য শোয়ার সময় খুব নিচু বালিশ কিংবা সার্ভাইক্যাল পিলো ব্যবহার করতে হবে। মূলত এ বালিশ থাকবে ঘাড়ের নিচে।
ঘাড়ে ব্যথা হলে এর চারপাশের মাংসপেশিগুলো শক্ত হয়ে ওঠে এবং এর সচলতা কমে যায়। তাপ হলো মাংসপেশিকে শিথিল করার ভালো ব্যবস্থা। এ কারণে পেশিতে গরম সেঁক দিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় গোসলের সময় ঘাড়ের ওপর গরম পানি ঢালা।
মালিশ বা ম্যাসাজ করলে ঘাড়ের ব্যথা কিছুটা উপশম হয়। এর ফলে ঘাড়ের টানটান পেশিগুলো শিথিল হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে, ম্যাসাজ বা মালিশ যেন উল্টাপাল্টা না হয়। ধীরে ধীরে দুই কাঁধে এবং ঘাড়ের মালিশ করতে হবে। কোনোভাবেই মাংসপেশিতে জোরে চাপ দেওয়া যাবে না, এতে সমস্যা হতে পারে।
ঘাড়ের মাংসপেশি শক্তিশালী করে তুলতে পারলেই ঘাড়ের ব্যথা কমানো সম্ভব। কারণ, ঘাড়ের মাংসপেশি দুর্বল হলে তা মেরুদণ্ডের ওপর প্রভাব পড়ে। আর যদি পেশিগুলো শক্তিশালী থাকে, তাহলে মেরুদণ্ডের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে না। কিছু ব্যায়ামের মাধ্যমে ঘাড়ের মাংসপেশিকে শক্তিশালী করা যায়। প্রাথমিক ব্যথা সেরে যাওয়ার পর এসব ব্যায়াম করা যেতে পার।
এসব কিছুর পরেও ব্যথা যদি তীব্র হয়, যদি কোনোভাবেই না কমে, তাহলে অবশ্যই এ ক্ষেত্রে একজন নিউরোলজিস্ট বা পেইন ম্যানেজমেন্টের কাছে পরামর্শ নিতে যেতে হবে। তাহলে তিনি এ ব্যথার সঠিক নির্ণয়ের মাধ্যমে আপনাকে ঠিক চিকিৎসা দিতে পারবেন।
মন্তব্য করুন