রাসেল ভাইপার। ভয়ংকর বিষধর এক সাপ। এক দশক আগেও সাপটির অস্তিত্ব সম্পর্কে খুব বেশি শোনা যায়নি।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের নানা অঞ্চলে এটি ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে পদ্মা-যমুনা নদী ও তার অববাহিকায়।
চলতি বছর দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফসলের ক্ষেতে কাজ করার সময় রাসেল ভাইপারের আক্রমণে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে। এসব এলাকায় রাসেল ভাইপারের আতংক এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, ক্ষেতের পরিচর্যার জন্য শ্রমিকও পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি ফসল কাটতে ক্ষেতে যেতেও ভয় পাচ্ছেন কৃষকরা।
আতংক বিবেচনায় নিয়ে ক্ষেতে কাজ করার সময় সাপ থেকে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য কৃষকদের নানা পরামর্শও দিচ্ছে কৃষি বিভাগ। তবুও ভয় কাটছে না কৃষকদের।
গত ৮ এপ্রিল রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের চর মজলিশপুর এলাকায় ভুট্টাক্ষেত পরিচর্যাকালে সাঈদুল শেখ নামের এক কৃষককে সাপে ছোবল দেয়। এর সাত দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
এর কয়েকদিন আগে ২৯ মার্চ গোয়ালন্দের দেবীপুর চরে ময়না বেগম নামের এক শ্রমিককে সাপে ছোবল দেয়। পরে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফেরার ১৪ দিন পর ময়না বেগমের মৃত্যু হয়।
এ দুটি ঘটনার শিকার ব্যক্তিরা রাসেল ভাইপারের দংশনের শিকার হয়েছিল বলে উপসর্গ দেখে নিশ্চিত করেছেন চিকিৎসকরা।
অন্যদিকে গত ১ মার্চ দুপুরে মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের চরে ভুট্টা ক্ষেতে পানি দেওয়ার রাসেল ভাইপারের আক্রমণের শিকার হন শেখ লাল মিয়া। হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পরও ছয় দিন পর তার মৃত্যু হয়।
একই দিনে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে পদ্মা নদীতে মাছ ধরছিলেন ভাটা ব্যবসায়ী তারিক শেখ। এ সময় রাসেল ভাইপার তাকে কামড় দেয়। পরে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাঁচ দিন পর তার মৃত্যু হয়।
আবার গত ৭ মার্চ ফরিদপুরের চর ভদ্রাসনের চর শালেপুরে সরিষা কাটতে গিয়েছিলেন কৃষক বিশা প্রামাণিক। ওই দিন দুপুর ১২টার দিকে তাকে রাসেল ভাইপারে কামড় দেয়।
এরপর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সর্বশেষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন তিনি। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। সাপে কামড় দেওয়ার ৩৬ দিন পর ১৩ এপ্রিল তার মৃত্যু হয়।
সর্বশেষ চলতি মাসের ৬ তারিখে রাসেল ভাইপার সাপের দংশনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীরও মৃত্যু হয়েছে।
রাসেল ভাইপারের কামড়ে সাঈদুল শেখ ও ময়না বেগমের মৃত্যু খবর এলাকায় ভালোভাবেই জানাজানি হয়েছে। এরপর থেকে পদ্মা তীরবর্তী মজলিশপুর, দেবীপুর, চর দৌলতদিয়া ও আংকের শেখেরপাড়া এলাকার কৃষকরা ভয়ে ক্ষেত পরিচর্যা, সেচ ও সার প্রয়োগ এমনকি ফসলও কাটতে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। এসব এলাকায় কাজের পাওয়া যাচ্ছে না কৃষি শ্রমিক।
গোয়ালন্দের উজানচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. গোলজার হোসেন মৃধা কালবেলাকে বলেন, মজলিশপুর, দেবীপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন চর এলাকায় কৃষিক্ষেতে সাপের উপদ্রবের কথা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। এতে ভয়ে ওই এলাকার জমিতে কাজ করতে চাচ্ছেন না শ্রমিকরা।
একই অবস্থা চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার মেঘনা নদীর তীরবর্তী চরাঞ্চলগুলোতে।
এমনই একটি চর এখলাসপুরের ইউপি চেয়ারম্যান মো. মফিজুল ইসলাম মুন্না ঢালী বলেন, এখন ধান কাটার মৌসুম। কিন্তু সম্প্রতি ধানক্ষেতে বিষাক্ত রাসেল ভাইপারের দেখা মিলেছে, যেগুলো মেরে ফেলেছেন কৃষকরা। কিন্তু তারপরও হঠাৎ এই সাপের উপস্থিতি বেশ আতঙ্ক তৈরি করেছে। এখন ভয়ে কোনো শ্রমিক জমিতে ধান কাটতে চাচ্ছে না।
পাশাপাশি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার জেলার ধানক্ষেত থেকে বেশ কয়েকটি রাসেল ভাইপার মেরেছেন কৃষকরা। এতে সেখানেও আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। ফসল কাটতে ক্ষেতে যেতে ভয় পাচ্ছেন কৃষকরা।
বাংলাদেশ বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা এবং তরুণ বন্যপ্রাণী গবেষক জোহরা মিলা জানান, রাসেল ভাইপার (Russell's Viper) সাপটি ‘চন্দ্রবোড়া’নামেও পরিচিত।
‘রাসেল ভাইপার দেখতে মোটাসোটা তবে লেজ সরু হয়ে থাকে। মাথা ত্রিভুজাকার এবং ‘V’ আকৃতির সাদা রেখা আছে। শরীরের পৃষ্ঠতল বাদামী এবং বৃত্তাকার বা ডিম্বাকৃতির গাঢ় চিহ্নের তিনটি লম্বা সারি রয়েছে। সাপটির গায়ে ছোপ-ছোপ গোলাকার কালো দাগ থাকে।’
তিনি বলেন, ‘সাপটি লম্বায় তিন থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত হয়। মাথার তুলনায় ঘাড় বেশ সরু। এর গায়ের রং হালকা হলদে বাদামী। ফলে শুকনো ঘাস-পাতার মধ্যে নিজেকে সহজেই লুকিয়ে রাখতে পারে। আতংকিত হলে বা হুমকি অনুভব করলে জিহ্বা বের করে প্রচণ্ড হিসহিস শব্দ করে।
সাপটি সম্পর্কে যার ধারণা নেই তিনি এটিকে অজগর ভেবেই ভুল করবেন। এই প্রজাতিটি প্রাথমিকভাবে নিশাচর হিসেবে সক্রিয়। অর্থাৎ সাধারণত রাতে শিকার বা খাদ্যের সন্ধানে বিচরণ করে এই সাপ।’
দেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে বিশেষত পদ্মার চরাঞ্চল, নদী অববাহিকা ও বরেন্দ্র এলাকায় উঁচু-নিচু ঘাস বা ফসলের জমিতে এই সাপটি বেশি দেখা যায়। তবে বিগত কয়েক বছরে সাপটি দেশের নদী বিধৌত বেশ কয়েকটি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।
জোহরা মিলা বলেন, ‘এই সাপটি কোনো নির্দিষ্ট আবাসস্থলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, এবং যদিও এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খোলা, ঘাসযুক্ত বা ঝোপঝাড় এলাকায় পাওয়া যায়। তবে এটি বনে, আবাদী এবং কৃষিজমিতেও দেখা যেতে পারে।
এটি ঘন বন এড়িয়ে চলে এবং সমভূমি, উপকূলীয় নিম্নভূমি এবং পাহাড়ে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এই প্রজাতিটি প্রায়ই গ্রামাঞ্চলে বসতির আশেপাশে পাওয়া যায়, যেখানে ইঁদুরের বিস্তার বেশি। অন্যান্য সাপের তুলনায় এই সাপের বংশবিস্তারের হারও বেশি। প্রজাতিভেদে বাংলাদেশের রাসেল ভাইপার ৬-৬৩টি বাচ্চা প্রসব করে।’
তিনি বলেন, দুই দশক আগেও রাসেল ভাইপার খুব একটা দেখা যেত না, কিন্তু গত এক দশকে এই সাপের সংখ্যা বা বিস্তার বেশ বেড়েছে।
তার ধারণা, রাসেল ভাইপার স্থলজ সাপ হলেও অনেকক্ষেত্রে এটি বন্যার পানিতে বা কচুরি পানায় ভাসতে ভাসতে বহুপথ অতিক্রম করতে পারে। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চল থেকে সাপটি হয়তো এভাবেই পদ্মা নদী অববাহিকার জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।
সাম্প্রতিককালে ফসলের বিশেষ করে ধানক্ষেতে রাসেল ভাইপারের উপস্থিতি নিয়ে জোহরা মিলা বলেন, ‘ইঁদুর, ব্যাঙ, ছোট পাখি ও টিকিটিকি রাসেল ভাইপারের প্রিয় খাবার। যেহেতু ফসলের ক্ষেতে ইঁদুরের উৎপাত বেশি তাই খাবারের খোঁজে সেখানে গিয়ে হাজির হয় রাসেল ভাইপার।’
‘এ ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ঝোপঝাড়ের পরিমাণও কমে গেছে। ফলে অনেক সময় বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ ও পর্যাপ্ত খাবার পেয়ে ফসলের ক্ষেতের আশেপাশেই আবাস গড়েছে এই সাপ; বংশবিস্তার করছে। কৃষকরা যেহেতু ফসলের ক্ষেতেই কাজ করেন তাই তারাই বেশি রাসেল ভাইপারের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন।’
‘তাছাড়া বসতবাড়ির আশপাশেও ইঁদুর ও টিকটিকি প্রাচুর্যতা বেশি থাকায় খাবারের খোঁজে রাসেল ভাইপার অনেক সময় লোকালয়ে চলে আসে এবং মানুষকে দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আক্রমণ করে বসে’, বলেন তিনি।
আইইউসিএনের ২০১৫ সালের লাল তালিকা অনুযায়ী রাসেলস ভাইপার বাংলাদেশে প্রায় হুমকিগ্রস্ত প্রাণীর তালিকায় রয়েছে। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী সাপটি রক্ষিত প্রাণী বলেও জানান এই বন্যপ্রাণী গবেষক ও বন কমকর্তা।
রাসেল ভাইপার অত্যন্ত বিপজ্জনক সাপ। তবে এর সামনে পড়লে আতংকিত না হয়ে সাবধানতার সাথে সে স্থান থেকে সরে যাওয়াই উত্তম বলে মনে করেন জোহরা মিলা। তবে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে সাপটির কবল থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
তার ভাষায়, ‘মাঠে কাজ করার সময় অবশ্যই গামবুট ও জিন্সের প্যান্ট পড়তে হবে যেন বাড়তি নিরাপত্তা পাওয়া যায়। কাজ শুরুর আগে ছোট বাঁশ বা লাঠি বা অন্য কিছু দিয়ে শব্দ করতে হবে যেন, আশেপাশে রাসেল ভাইপার থাকলে তা দূরে সরে যায়। জমিতে কাজের ফাঁকেও এটি করতে হবে।’
‘নিশ্চিত না হয়ে কোনোভাবেই ঝোপঝাড়, বড় ঘাস, পুরাতন ও দীর্ঘদিন পড়ে থাকা ইট-পাথরে হাত দেবেন না’, যোগ করেন তিনি।
সর্বোপরি যেসব এলাকায় এই সাপের উপদ্রব রয়েছে সেসব এলাকায় চলাফেরা ও দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত বলেও মনে করেন এই বন কর্মকর্তা।
শুধু রাসেল ভাইপার নয়, যে কোনো সাপের কামড়ের শিকার হলেই ওঝার কাছে যাওয়া যাবে না বলে জোর পরামর্শ দেন জোহরা মিলা।
তিনি বলেন, ‘ওঝার কাছে না গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শে নির্দিষ্ট অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করতে হবে।’
এক্ষেত্রে সম্ভব হলে যে সাপ দংশন করেছে, তা চিহ্নিত করার জন্য সেই সাপের ছবি তুলে স্থানীয় বন কর্মকর্তা ও চিকিৎসককে দেখানোর পরামর্শ দেন জোহরা মিলা।
এদিকে চিকিৎকদের মতে, রাসেল ভাইপারের কামড়ালে আক্রান্ত ব্যক্তির হাত-পা অস্বাভাবিক ফুলে ওঠে। তাছাড়া রাসেল ভাইপারের দংশনের পর চিকিৎসা নিতে দেরী হলে রোগী মারা যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে শক, পেশী প্যারালাইসিস, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রক্তক্ষরণ এবং কিডনি অথবা রেনাল ফেইলিয়র।
এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক মোহাম্মদ হাসান তারিক বলেন,
রাসেল ভাইপারের দংশনের শিকার ব্যক্তির কিডনি দ্রুত অকেজো হতে শুরু করে। শরীর জ্বালাপোড়া করার পাশাপাশি দংশনের স্থানে পচন ধরে। একইসঙ্গে দংশনের শিকার ব্যক্তির রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। এসব ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা দেওয় না হলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।
সাপটির দংশনের শিকার ব্যক্তিদের চিকিৎসার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে এই চিকিৎসক আরও বলেন, রাসেল ভাইপারের এন্টিভেনম থাকলেও সেটা খুব একটা কাজ করে না। ২০১৫ সালের দিকে আমরা প্রথম রাসেল ভাইপারে কামড়ানো রোগী পেয়েছিলাম। সে সময় আক্রান্ত হাত-পা কেটে ফেলেও রোগীকে বাঁচানো যায়নি। তাই সাপটির কবল থেকে বাঁচতে সচেতনতাই কার্যকর পথ।
মন্তব্য করুন