নানাভাবে দুটি সপ্তাহ পাড়ি দিচ্ছে দুবাই জলবায়ু সম্মেলন। ২০০টি দেশ, সত্তর হাজার মানুষ, সহস্র প্রশ্ন। কিন্তু কিছুই বিশ্বনেতৃত্বের নির্বিকার বাহাদুরি থামাতে পারল না। গাজায় বোমা বর্ষণ থামল না। কেনিয়া, তাঞ্জানিয়া কি ভারতে অকালবন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে নিহত হলো শত প্রাণ। ফিলিপাইন কি বাংলাদেশ কেঁপে ওঠল ভূমিকম্পে। বিজ্ঞান বারবার স্পষ্টভাবে প্রমাণসমেত বলছে এসব উল্টাপাল্টা আচরণের নাম জলবায়ু পরিবর্তন। কিন্তু বিশ্ববাহাদুররা এ বিজ্ঞান মানছে না। অধিক কার্বন নির্গমণকারী কোম্পানি ও দেশগুলোর নেতৃত্ব তা শুনছে না। মানুষ কি মাটির নিথর দেহ কিংবা ভয়ার্ত চিৎকার কোনোকিছুই দমাতে পারছে না জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বাহাদুরি। সভা, আলোচনা, প্রতিবাদী কর্মসূচি কিংবা নানা পক্ষীয় দেন-দরবারের ভেতর দিয়েই কেবল জলবায়ু সম্মেলন চলছে না। আলাপচারিতার আরও নানা ভাষ্য ও ভঙ্গিও কিছুটা উপস্থাপিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর ১৩ বছরের মেয়ে জিনেভিভ কাসামেন্টো ‘জেন এফ’ নামে একটি বই লিখে জলবায়ু আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানাতে এসেছেন। নাইজেরিয়ার লেখক ডিওরিমেনে কইকইবো এবং ওনম ইতিসিরো যৌথভাবে ‘আকাম্বা মাফিনা’ নামে একটি গল্পের বই লিখেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাণিসমাজ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এ বিষয়ে। ‘ইমাজিং নিউ ক্লাইমেট ন্যারেটিভ’ নামের এক তরুণদের সংগঠন সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের নানা গল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন, তারা বলছেন জলবায়ুর গল্পগুলো আমাদের বেশি করে বলা দরকার। আইভরি কোস্টের শিল্পী ইবনে শেইখ সাল্লাহ ডিইবকিলে তার কয়েকটি রি-সাইকেল চিত্রকর্ম নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে এসেছেন। ইথিওপিয়া প্যাভিলিয়নে আসনাকে মিলিসে, টিওডরস বেকেলে মেনগেসা, টিমার্ট সিলতানসহ বহু শিল্পীদের চিত্রপ্রদশর্নী হচ্ছে। জলবায়ু অধিকারকর্মী পূজা তিলভাওয়ালা সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মাধ্যমে কীভাবে জলবায়ু সচেতনতার বিষয়টি আরও বেশি কার্যকর করা যায় এ নিয়ে কাজ করছেন। ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধের আহবান জানিয়ে ভারতীয় তরুণ শিল্পী শিলো শিব সুলেমানের বানানো এক শাড়ি খুফিয়া নিয়ে দুবাই সম্মেলনে হেঁটেছেন অধিকারকর্মীরা। জলন্ত আর কার্বনে ঢাকা পৃথিবীর চিত্র ঝুলিয় নিরবে হেঁটেছেন দুই শিল্পী। খ্রিস্টধর্মালম্বীদের বড়দিনের আগে সান্তাক্লজ নানা উপহার ও আগামবার্তা নিয়ে হাজির হয়। সম্মেলনে একজন সান্তাক্লজের মতো করেই সেজেছেন, ‘সাসটেইনা ক্লজ’। সাসটেইনেবল লিভিংয়ের বার্তা জানাতে তিনি মানুষের সামনে গিয়ে কথা বলছেন। প্রথম সপ্তাহের পর যেন লোকজন কিছু কমেছে। এমনকি আজ সম্মেলনের ১১তম দিনে বহু দেশের প্যাভিলিয়ন এরকম ফাঁকা। লোকজন নেই। ভুটান, ইকুয়েডর, পেরু, ফিজি, সেন্ট কিটিস, বারবাডোজ, এন্টিগুয়া বারবুডার প্যাভিলিয়নগুলোতে কাউকে পাওয়া গেল না। তবে সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও বাহরাইন প্যাভিলিয়নে ভিড় কমেনি। হয়ত সিঙ্গাপুর প্যাভিলিয়নে চা, কফি, বিয়ার পাওয়া যায় আর বাহরাইনের দেওয়া স্যুভেনিয়রগুলো বেশ আকর্ষক। দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ শক্তি খাত নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। তবে জ্বালানিশক্তির ন্যায্য, টেকসই, পরিবেশবান্ধব, উপযোগী রূপান্তর নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষগুলোর উল্লেখযোগ্য তৎপরতা ছিল না। সম্মেলনের প্রথম সপ্তাহে আয়োজিত এক সহঅধিবেশনে এন্টিগুয়া ও বারবুডার স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সেক্রেটারি এনা ডালসো হেনরি জানান, ২০৩০ সালের ভেতর প্রায় ৮৬ ভাগ বিদ্যুৎ খাতকে নবায়নযোগ্য হিসেবে রূপান্তরের জন্য আমরা কাজ করছি। শতভাগ সাইকেল জাতীয় যানবাহনকে বিদ্যুৎশক্তিনির্ভর করা হয়েছে। প্রশ্ন করেছিলাম নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার ও কার্বণ নিঃসরণ নিয়ে রাষ্ট্রীয় গবেষণা ও নথিভুক্তকরণে কীভাবে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়? জবাবে এন্টিগুয়া এবং বারবুডার আলিয়াত টুইট জানান, ‘...আমাদের একটি কমিটি আছে যা প্রতিনিয়ত জনগোষ্ঠী, এনজিওসহ নানা পক্ষ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে আপডেট করা হয়।’ তবে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে গৃহীত কিছু প্রকল্প নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে বিভিন্ন অধিবেশনে। জাতিসংঘের ইউনওপসের নির্বাহী সিমোনা ম্যারিনেসকো প্রথম সপ্তাহে আয়োজিত এক সহঅধিবেশনে বলেন, ‘...আমরা নিঃসরণ কমানোর জন্য বেশিকিছু পরিকল্পনা করি কিছু খাতে যাতে এটি কমে এবং আবার দেখা যায় কিছু খাতে আমরা নিঃসরণ বৃদ্ধির জন্য নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করি। তাই আমাদের পরিকল্পনা হওয়া জরুরি কার্বন নিঃসরণ কীভাবে আমরা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনব।’ সম্মেলনের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে ২০২৩-৩১ সৌরসেচের স্কেলআপ রোডম্যাপটি ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশে প্রায় ১.২২ মিলিয়ন ডিজেলচালিত পাম্প এবং প্রায় সাড়ে চার লাখ বৈদ্যুতিক পাম্প ক্ষুদ্র সেচ কাজে ব্যবহৃত হয়। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে সেচকার্যক্রমকে সৌরবিদ্যুৎ নির্ভর করার জন্য রোডম্যাপটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ভূমিকা রাখবে। ২০৪০ সালের ভেতর জ্বালানি খাতকে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তর করতে চায় বাংলাদেশ। সম্মেলনের সপ্তম দিনে জীবাশ্ম জ্বালানি রোধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আনা এক প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন ও জাপান ছাড়া ১০৬টি দেশ এতে স্বাক্ষর করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র নতুনভাবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র না করার সুপারিশ দিয়ে আরেকটি প্রস্তাব এনেছে, যাতে চীন ও ভারত সম্মত নয়। বিশ্বের প্রায় ২৫০টি সংগঠন প্রাকৃতিক গ্যাস তরলীকরণ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে আহবান জানিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া আবারও কেবল প্যাসিফিক অঞ্চলে ১৫ কোটি ডলার অঙ্গীকারের ভেতর দিয়ে জলবায়ু অর্থায়নে ফিরে এসেছে। ভুটান যেন সব দিক থেকে আলাদা। যখন পৃথিবীর সবাই ‘নিজেদের উন্নয়ন মাপে টাকা দিয়ে জিডিপিতে, তখন ভুটান মাপে ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস বা জিএনইইচ’ দিয়ে। তারা সুখ-শান্তির সূচক অনুশীলন করে। নবায়নযোগ্য শক্তি ও কার্বন নিঃসরণ হ্রাস বিষয়েও ছোট্ট দেশ হিসেবে ভুটান তুলে ধরেছে বিশাল এ স্বপ্ন। তারা ‘কার্বন নিউট্রালিটি বা কার্বন-নিরপেক্ষ’ দেশ হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার পরিকল্পনা তুলে ধরেছে। সম্মেলনের দ্বিতীয় ‘বৈশ্বিক পূর্ববর্তী অঙ্গীকার বা গ্লোবাল স্টকটেক’ নিয়ে দ্বিতীয় সপ্তাহের অধিবেশনে আলোচনা হয়েছে। দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ রাষ্ট্রপক্ষ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানান দেয়, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির ভেতরে রাখতে হলে অবশ্যই জীবাশ্ম জ্বালানি বিষয়কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জলবায়ু সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণেরও দাবি জানায় বাংলাদেশ। ‘বৈশ্বিক অভিযোজন লক্ষ্যের’ খসড়া নিয়ে আলাপ তুলেছে বাংলাদেশ। বিশ্বনেতৃত্বকে বাংলাদেশ জলবায়ু তহবিলের অঙ্গীকারগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়ে দ্রুত ব্যবস্থাগ্রহণের আহবান জানিয়েছে। বিশেষ করে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জলবায়ু তহবিল, সবুজ জলবায়ু তহবিল, ক্ষয়ক্ষতি তহবিল, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য তহবিল, অভিযোজন তহবিল এবং বৈশ্বিক পরিবেশ সহায়তা তহবিলগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করে সকল তহবিলে বাংলাদেশের দ্রুত ও সহজ অভিগম্যতা দাবি করেছে বাংলাদেশ। সম্মেলনে শিশু, তরুণ, যুব, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী মানুষ, পেশাজীবী, শ্রমিক, অভিবাসী, জলবায়ু-উদ্বাস্তুদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং উদাহরণমূলক জায়গা খুব বেশি ছিল না। ‘জলবায়ু সংকট কার্যত শিশু অধিকারের সংকট : শিশুদের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিসিআরআই) প্রবর্তন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ইউনিসেফ প্রথম শিশুকেন্দ্রিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক তৈরি করেছে। ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী জলবায়ুগত ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর ভেতর প্রথম দিকে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান রয়েছে। প্রায় ১০০ কোটি শিশু জলবায়ুগত কারণে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ৩৩টি দেশে বাস করে। জলবায়ুগত কারণে শিশুদের ঝুঁকি ও মোকাবিলা নিয়ে শিশুদের কথাগুলো জানা-বোঝার জন্য পৃথক শিশুবান্ধব জায়গা তৈরি করা দরকার।
সম্মেলনে নগরায়ণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ুগত স্থানান্তর নিয়ে আলাপ হলেও নগরদরিদ্রদের বিষয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি। মালদ্বীপের পরিবেশ ও জ্বালানিশক্তি মন্ত্রণালয়ের জলবায়ুবিষয়ক বিভাগের পরিচালক আহমেদ ওহায়েদ জানান- ‘...বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মালদ্বীপের জন্য একটি বড় রকমের চ্যালেঞ্জ। করোনা মহামারির লকডাউনের ভেতর আমরা একটা ডায়গনস্টিক সমীক্ষা করেছি। জলবায়ু ঝুঁকি এবং দক্ষতা অর্জনের খাতগুলো বোঝার জন্য গবেষণা, জাতীয়ভাবে তথ্য বিশ্লেষণ এবং তথ্য সাধারণীকরণ করা একটা কঠিন বিষয়। কিন্তু এসব দক্ষতা অর্জন না করলে আমরা জলবায়ুর সামগ্রিক ঝুঁকিকে বুঝতে পারব না। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে।’ দুবাই এক্সপো সিটি ২০২০ তৈরি করা হয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম মেলা আয়োজনের ভেন্যু হিসেবে। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে বাণিজ্যমেলা তখন হয়নি। আর এখানেই আয়োজিত হয়েছে ২৮তম জলবায়ু সম্মেলন। বহু দেশ তাদের প্যাভিলিয়নে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং বন সংরক্ষণে রাষ্ট্রগুলোর অর্জন এবং পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছে। ওমান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো প্যাভিলিয়নে ‘ভার্চুয়াল রিয়েলিটির’ মাধ্যমে বেশকিছু বিষয় তুলে ধরেছেন। বহু দেশ তাদের প্যাভিলিয়নের সজ্জা ও উপস্থাপনে দারুণভাবে নিজেদের দেশ, জলবায়ু সংকট ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে আজারবাইজান, ভুটান, কিউবা, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মাদাগাস্কার, পানামা, কলম্বিয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষভাবে ইথিওপিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্যাভিলিয়নে সৃজনশীলতা ও দায়িত্ববোধের ছাপ আছে। এক্সপ্রোসিটিতে ‘স্টোরিজ অব নেশসন’ নামে ৩টি প্রদর্শনী গ্যালারি আছে। একটির নাম ‘মবিলিটি’, একটি ‘ওপরচুনিটি’ এবং অন্যটি ‘সাসটেইনবিলিটি’। এসব গ্যালারিতে বিভিন্ন দেশের শিল্পকলা ও সম্ভাবনা প্রদর্শিত হচ্ছে। বাংলাদেশের পাটজাত শিল্পসামগ্রী প্রদর্শিত হচ্ছে ‘সাসটেইনবিলিটি’ গ্যালারিতে। সম্মেলনস্থলটি প্রধানত ‘নীলাঞ্চল (ব্লু জোন)’ এবং ‘সবুজাঞ্চল (গ্রিন জোন)’ বিভক্ত। জাতিসংঘের ব্যাজ নিয়ে সবাই নীলাঞ্চলে প্রবেশ করতে পারেন কিন্তু সবুজাঞ্চলে প্রবেশ করতে পারেন যে কেউ। সবুজাঞ্চলের টেরা প্রদর্শনী গ্যালারিটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সম্মেলনের শেষ ১১তম দিন ও দ্বাদশ দিনটিতে চূড়ান্ত দেন-দরবার চলছে। আশা করছে সবাই বিশ্ব নেতৃত্বে কার্যকর সমাধানে এগিয়ে যাবেন।
.
লেখক : গবেষক
মন্তব্য করুন