বর্তমান প্রজন্মের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম জলবায়ু পরিবর্তন। এটি আমাদের মানব অস্তিত্বের প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মূলত বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ভূমিকম্প, নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা এবং লবণাক্ততা প্রভৃতি। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস’ (কপ-২৮)-এর এবারের আসর গত ৩০ নভেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের এক্সপো সিটিতে উদ্বোধন করা হয়।
জাতিসংঘের কপ-২৮ জলবায়ু সম্মেলনের তৃতীয় দিনে বিভিন্ন দেশের নেতাদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে। তৃতীয় দিনের আলোচনায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে- এর মধ্যে নতুন লস এবং ড্যামেজ তহবিল, কার্বন নির্গমন, মিথেন গ্যাস, নবায়নযোগ্য জ্বালানি অন্যতম বিষয়।
সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান সম্মেলনে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকট সমাধানে ‘আলটেরা তহবিল’ নামের ৩ হাজার কোটি ডলারের তহবিল গঠনের ঘোষণা দেন। কপ-২৮ সম্মেলনের সভাপতি সুলতান আল জাবের এ নতুন তহবিল বোর্ডের প্রধান হবেন। তারা আশা করছেন নতুন তহবিলটি ২০৩০ সালের মধ্যে মোট ২৫ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগে সক্ষম হবে এবং একটি ন্যায্য জলবায়ু অর্থায়ন ব্যবস্থা তৈরি করতে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে সামনের দিকে অগ্রসরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। একই সাথে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য আরও বেশি তহবিল পাওয়ার সুযোগ তৈরিতে জোর দেবে আলটেরা নামের তহবিলটি।
যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ুবিষয়ক দূত জন কেরি নেট শূন্য লক্ষ্য পূরণের জন্য ২২টি দেশ একযোগে ২০৫০ সালের মধ্যে পারমাণবিক শক্তি তিনগুণ করার আহ্বান জানিয়েছে। এক বক্তব্যে কেরি বলেন, পারমাণবিক শক্তি অন্যান্য শক্তির উত্সের জন্য একটি সুস্পষ্ট বিকল্প হতে চলেছে। বিজ্ঞান এবং তথ্য-প্রমাণের বাস্তবতা বলছে পারমাণবিক শক্তি ছাড়া ২০৫০ নেটশূন্য অর্জন করা সম্ভব হবে না। এগুলো বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা, এর সঙ্গে কোনো রাজনীতি জড়িত নয়। অন্যদিকে, বিল ম্যাককিবেনের আন্তর্জাতিক ফসিল ফুয়েলবিরোধী মুভমেন্ট ৩৫০ ডট ওআরজির একজন জাপান প্রচারক মাসায়োশি আইওদা বলেছেন, প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী ডিকার্বনাইজেশনকে ত্বরান্বিত করার জন্য বিপজ্জনক পারমাণবিক শক্তির জন্য কোনো স্থান নেই। এটি একটি বিপজ্জনক বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। ২০০০-এর দশক থেকে পারমাণবিক শিল্পের লবিস্টদের নেতৃত্বে একটি ‘পারমাণবিক নবজাগরণের’ প্রচেষ্টা চলছিল- যা কখনই সফল হয়নি। এটি কেবল ব্যয়বহুলই নয় বরং খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, অগণতান্ত্রিক এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। জলবায়ু সংকটের জন্য আমাদের কাছে ইতোমধ্যেই সস্তা, নিরাপদ, গণতান্ত্রিক এবং দ্রুত সমাধান রয়েছে এবং সেগুলো হলো নবায়নযোগ্য শক্তি এবং অধিক দক্ষতা সম্পন্ন শক্তি।
জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতার বিষয় উল্লেখ করে বার্বাডোসের প্রধানমন্ত্রী এবং জলবায়ু কূটনীতির একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব মিয়া মটলি বলেন, ‘Loss and damage alone, however, is only a part of the equation. Because for every dollar that we spend before disaster, we can save $7 in damage and indeed loss of lives’. বাস্তবতা হলো, আমরা যদি পথ পরিবর্তন না করি তাহলে আমরা আরও অনেক বেশি প্রাণ হারানো এবং অনেক বেশি ক্ষতি দেখতে পাব। এ ছাড়াও তিনি মিথেনের নিঃসরণ দ্রুত হ্রাস করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলোকে এককভাবে তুলে ধরেন, কারণ এটি কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকারক এবং তাপ কমাতে মিথেনের পরিমাণ কমাতে হবে বলে মন্তব্য করেন।
সম্মেলনে কলম্বিয়া জীবাশ্ম জ্বালানি অপসারণ চুক্তিতে যোগদান করেছে বলে ঘোষণা করেছে। এই চুক্তিতে যোগদানকারী ১০তম দেশ হলেও এই বছরের শুরুতে যোগদানকারী তিমুর-লেস্তেকে অনুসরণ করে জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী শুধু দ্বিতীয় সদস্য হলো কলম্বিয়া। দেশটিতে কয়লা, গ্যাস এবং তেলের উল্লেখযোগ্য মজুত রয়েছে। কলম্বিয়ার পরিবেশ মন্ত্রী সুজানা মুহাম্মাদ বলেছেন, কলম্বিয়া বিশ্বাস করে আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানি পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার পরিকল্পনা দরকার।
কপ-২৮ সম্মেলনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় খবর হলো বিশ্বের বৃহত্তম কয়লা জ্বালানি চীনের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সমস্ত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাওয়ারিং পাস্ট কয়লা জোটে যোগদান করেছে৷ কয়লা হলো সবচেয়ে নোংরা জীবাশ্ম জ্বালানি এবং এটি থেকে মোট দূষক নির্গমনের প্রায় ৪০% নির্গত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম কয়লা পোড়ানোর পাওয়ার স্টেশন রয়েছে। কয়লা শেষ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্ধারিত সময়সীমা হলো ২০৩৫ সাল। পাঁচ বছর পূর্বে অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রাকে ১.৫ ডিগ্রি সে.-এর নিচে রাখার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ক্লাইমেট অ্যানালিটিক্সের বিল হেয়ার বলেছেন, অস্ট্রেলিয়া এখনও কয়লা-নির্ভর দেশ এবং এখনও কয়লা রপ্তানির জন্য নতুন খনি অনুমোদন করছে। কয়লা উৎপাদন সম্প্রসারণ করা বৈশ্বিক বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় এবং আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা যা বলছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ।
এ ছাড়াও জাপানের কিকো নেটওয়ার্ক এনজিও থেকে ইভান গ্যাচ বলেছেন, পিপিসিএ তালিকায় জাপানকে না দেখাটা হতাশাজনক, তবে হয়তো অবাক হওয়ার কিছু নেই। জাপানে ১৭০টিরও বেশি কয়লা ইউনিট রয়েছে এবং এগুলো শেষ করার জন্য কোনো সঠিক পরিকল্পনা বা রোডম্যাপ নেই। জাপান জীবাশ্ম জ্বালানির আয়ু বাড়াতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যতদিন তারা এটি থেকে লাভ করতে পারে।
সম্মেলন আগামী ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে যেখানে প্রতিটি দেশের আলোচকরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাধারণ কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন এবং করবেন। যে কোনো চূড়ান্ত চুক্তি অবশ্যই উপস্থিত প্রতিটি দেশের দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে। সর্বসম্মত সম্মতির প্রয়োজনীয়তার অর্থ হলো চূড়ান্ত নথির প্রতিটি শব্দ যাচাই করা হবে।
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার : বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, যুগ্ম-সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। মোবাইল নম্বর : ০১৭১২-০১৭-৭২৫, ইমেইল : [email protected])
মন্তব্য করুন