আমি সব সময় কোয়ালিটিকে প্রাধান্য দিই। মানুষের জীবনের ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা নিয়ে গান করার চেষ্টা করি। মানুষের চারপাশে যে চিন্তাগুলো পড়ে থাকে সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে আমি গান আকারে একটা মেসেজ দেওয়ার চেষ্টা করি। যে কারণে আমার প্রতিটি গানের মধ্যেই মানুষ তার জীবনের গল্প খুঁজে পায়। সব ক্ষেত্রে আমি আমার সংগীত দিয়ে অবদান রেখেছি। কালবেলার সঙ্গে আলাপে এসব কথা বলছিলেন কণ্ঠশিল্পী মনির খান।
মনির খানের প্রেমের গানগুলোতে ‘অঞ্জনা’ নামে এক নারীর নানামাত্রিক বিচরণ রয়েছে। শ্রোতাদের ধারণা, এই অঞ্জনার কাছেই প্রেমে ব্যর্থ হয়েছেন কণ্ঠশিল্পী। মনির খান বলেন, মানুষ বিভিন্ন কথা বলে। তাজমহল নিয়েও মানুষের বিভিন্ন ধারণা আছে। মানুষের ধারণা মানুষের কাছেই থাকুক। আমার গান থাকুক আমার কাছে। মানুষ চলছে আমিও চলছে। অঞ্জনাকে নিয়ে গাওয়া গানগুলো এখন পাবলিক প্রোপার্টি হয়ে গেছে। এটা এখন আর আমার কাছে নেই।
আলাপের মাঝে শৈশবের স্মৃতিচারণও করেছেন মনির খান। গানের ভূবনে আসার বিষয়ে বলেন, ১৯৮৭ সালে আমি এসএসসি পরীক্ষা দিই। এরপর বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, রেজাল্ট হতে যতদিন সময় লাগবে ততদিন কী করবে? তখন আমি মাঠেঘাটে চিৎকার করে গাইতাম; বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ফাংশনে যেতাম, পাড়া-মহল্লায় প্রোগ্রাম করতাম। তখন মানুষ জানত, আমি ভালো গান করছি। বাবা আমাকে বললেন, চলো একটা হারমোনিয়াম কিনে নিয়ে আসি। এই শুরু হলো। হারমোনিয়াম কিনে আনার পরই ওস্তাদ রেজা খসরু স্যারের কাছে গেলাম আমি। প্রতি শুক্রবার গান শিখতে যেতাম। এরপর স্বপন চক্রবর্তী স্যার ও ইউনুস আলী মোল্লা স্যার। এরপর গেলাম খন্দকার এনায়েত হোসেন স্যারের কাছে। ওনার কাছে কিছুদিন গান শোনার পর ঢাকায় চলে আসি। ঢাকায় এসে অনেকের কাছে শিখেছি।
গান মানেই সাধনা। তাই সুযোগ পেলে নিয়ম করে কণ্ঠ সাধতে বসে পড়েন মনির খান। বললেন, আমি যদি সুস্থ থাকতে চাই তাহলে প্রতিদিন তিন বেলা খেতে হবে। কিন্তু কণ্ঠ সুস্থ রাখার খাবার কী? কণ্ঠ সুস্থ রাখার খাবার হলো রেওয়াজ। আমি যতক্ষণ বাসায় থাকি, আমার হাতে হারমোনিয়াম থাকে। তিন ঘণ্টার নিচে কখনো প্র্যাকটিস করি না। ঘুমোতে যাওয়ার আগে প্র্যাকটিস করি; ঘুম থেকে উঠে প্র্যাকটিসে করতে বসি। খুব কম সময়ে আমি হারমোনিয়াম ছাড়া থাকি। এটাই আমার নেশা, এটাই পেশা, এটা আমার রুটি-রুজি। এর বাইরে কোনো স্বপ্ন-সাধনা আমার নেই।
তিনি আরও বলেন, সব জায়গায় আমার ইন্সট্রুমেন্ট রাখা আছে। যাতে যখনই সুযোগ পাই, যেন রেওয়াজটা করতে পারি। ইন্সট্রুমেন্টের অভাবে যেন রেওয়াজ বন্ধ না থাকে। আমি দেশের বাইরে গেলেও ইলেকট্রিক তানপুরা নিয়ে যাই। যেই হোটেলে উঠি বা যেখানে যাই, আমি সময়মতো রেওয়াজ করি।
নিজের সন্তানদের গানমুখী করার বিষয়ে বলেন, আমার দুটি সন্তান। প্রথমটি মেয়ে দ্বিতীয়টি ছেলে। মেয়ে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিল। ছেলেটা ক্লাস ফাইভে পড়ছে। সংগীত নিয়ে ওদের মধ্যে কোনো তাড়াহুড়া বা ব্যস্ততা নেই। ছেলে মাঝেমধ্যে বসে হারমোনিয়াম বাজানোর চেষ্টা করে; আমার সামনে কখনো বসতে চায় না। স্কুল থেকে ফোন করে শিক্ষকরা মাঝেমধ্যে জানান আমার ছেলে গান গেয়েছে পুরস্কার পেয়েছে। এভাবে চলছে আরকি। ওদের ভাগ্যে কী আছে ওরা জানে। তবে ওরা যে যেদিকে যেতে চায় যাক। আমার কোনো আপত্তি নেই।
গানের পাশাপাশি প্রকৃতির প্রেম মনে লালন করেন কণ্ঠশিল্পী মনির খান। গাঁয়ের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ মেলে না বলে গাজীপুরে কিছু জমি কিনে সেখানে লোক রেখে চাষবাস করাচ্ছেন। সেখানেই মাঝেমধ্যে যান সপরিবারে। বললেন, আমি তো গ্রামের মানুষ। আমার জন্ম ঝিনাইদহ জেলার, মহেশপুর থানার মদনপুর গ্রামে। আমার বাবা-মা এখনো গ্রামেই থাকেন। আমি প্রতি মাসেই গ্রামে যাই। গ্রাম আমাকে সাংঘাতিক টানে। আমার স্ত্রী-সন্তান গ্রাম পছন্দ করেন খুব। এখান থেকে আমার বাড়িতে যাওয়া অনেক কষ্টকর ছিল আমার জন্য। ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় লাগত। তখন আমরা চিন্তা করলাম কাছাকাছি যদি কিছু করা যায়; তখন আমার এক ভাই গাজীপুরে কিছু জমি কিনলেন। তিনি বললেন তুমি আমার কাছাকাছি থাক। ওখানে তিন চার বিঘা জমিয়ে রাখতে বললেন। তখন দামও অনেক কম ছিল। আমার কাছে তখন টাকা ছিল না। ভাই কিনে দিল। পরে ধীরে ধীরে আমি ঋণ শোধ করেছি। সেখান থেকে বাড়াতে বাড়াতে এখন ১২ বিঘার ওপরে আছে জমি। ২০০৫ সালে ওখানে জাম কিনতে শুরু করেছিলাম।
তিনি আরও বলেন, ওখানে যে চাষবাস হয় সেটা বাণিজ্যিকভাবে নয়। আমার চোখের ক্ষুধা মেটানোর জন্য, একটু তৃপ্তির জন্য এটা করা। ওই একটা দুইটা গরু বা ৫টা-দশটা হাঁস বা কয়েকশ মুরগি, এরকম রয়েছে। আমি গিয়ে সেখানে খাবার-দাবার দিই। ওখানে দুজন লোক আছেন, তারা এসব দেখাশোনা করেন। কিছু ফলের বাগান আছে, পুকুর আছে একটা। কোনো পরিচর্যা নেই সে রকম। গেলে পছন্দ হবে না। কিন্তু আমার ভালো লাগে।
মন্তব্য করুন