‘কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়া-লক্ষ্মী নারী’। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের ইতিহাস দীর্ঘকালের হলেও নজরুলের এ চরণের মতো করে নারীর অংশগ্রহণের ইতিহাস সমতার নয়। বাংলা চলচ্চিত্র যুগের পর যুগ নানাভাবে নারী-পুরুষের সামাজিক বৈষম্যকে টিকিয়ে রেখেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জয়গান গাইতে গিয়ে। নারী চরিত্রে পুরুষ অভিনেতার প্রথা ভেঙে নারী অভিনেতার উপস্থিতি দীর্ঘদিন হলেও নির্মাতা হিসেবে নারীদের অংশগ্রহণ একেবারেই হাতেগোনা। চলচ্চিত্রে নারী চরিত্রের উপস্থাপন নিয়ে এখনো সমাজের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে বিতর্ক। বেশিরভাগ চলচ্চিত্রে নারীর চরিত্রের চেয়ে তার বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতিই গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফর্সা, লম্বা, টিকালো নাক, টানা চোখ এসব ছকে ফেলেই হয় সৌন্দর্যের বিচার। ক্যামেরার পেছনের পুরুষতান্ত্রিক চোখ নারীকে এভাবে উপস্থাপন করে দর্শক টানার চেষ্টা করে। ছকবাঁধা এ সৌন্দর্যের বাইরে অনেক অভিনেত্রী দক্ষ হয়েও ইন্ডাস্ট্রিতে পিছিয়েও যান।
এমনই আলোচনা উঠে এসেছে দুদিনব্যাপী ‘একাদশ আন্তর্জাতিক উইমেন ফিল্ম মেকারস কনফারেন্স’-এর প্রথম দিনে। রোববার (১২ জানুয়ারি) ২৩তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের দ্বিতীয় দিনে উৎসবের অংশ হিসেবে ঢাকা ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয় এ কনফারেন্স। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সেন্ট্রাল উইমেনস ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান। চলচ্চিত্রে নারীদের অবস্থান নিয়ে তিনি বলেন, ‘লৈঙ্গিক সমতা আনার এখনই উপযুক্ত সময়। নারীদের মূলধারার সিনেমা ও বিকল্প সিনেমায় এগিয়ে যেতে হবে। সিনেমায় কোনো লিঙ্গকে যেন আক্রমণ করা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উৎসবের চেয়ারপারসন কিশওয়ার কামাল। বিশেষ অতিথি ছিলেন অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির এবং চীনের চলচ্চিত্র পরিচালক ও লেখক ঝ্যাং ইয়ুদি। আরও ছিলেন উৎসব পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামাল। অনুষ্ঠানে অতিথিদের আলোচনায় চলচ্চিত্রশিল্পে নারীর ভূমিকা, অবস্থান, সংকট ও প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা উঠে আসে।
এ বছর উৎসবে দেখানো হচ্ছে ৭৫ দেশের ২২০টি সিনেমা। শনিবার (১১ জানুয়ারী) বিকেল ৪টায় জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথি হিসেবে উৎসব উদ্বোধন করেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। উদ্বোধনী চলচ্চিত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে চিউ ঝ্যাংয়ের চীনা ছবি ‘মুন ম্যান’। এ বছর উৎসবের ফোকাস কান্ট্রি হিসেবে আছে চীন। বাংলাদেশ ও চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে চীনা চলচ্চিত্রের পোস্টার প্রদর্শনী হয় এদিনে। উৎসবের পর্দা নামবে ১৯ জানুয়ারি। রাজধানীর ৬টি ভেন্যুতে ৯ দিনব্যাপী এই উৎসবে অংশ নেবেন দেশ-বিদেশের অনেক চলচ্চিত্র কলা-কুশলী।
উৎসবে এশিয়ান প্রতিযোগিতা বিভাগ, রেট্রোস্পেকটিভ বিভাগ, বাংলাদেশ প্যানোরামা, ওয়াইড অ্যাঙ্গেল, সিনেমা অব দ্য ওয়ার্ল্ড, চিলড্রেন ফিল্ম, স্পিরিচুয়াল ফিল্ম, শর্ট অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম ও উইমেনস ফিল্ম সেকশনে দেখানো হচ্ছে পূর্ণ ও স্বল্পদৈর্ঘ্যের সিনেমা। দেখা যাচ্ছে জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তন ও কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে, শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তন, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ও গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে। উৎসবের অংশ হিসেবে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে উৎসবে থাকছে কয়েকটি বিশেষ প্রদর্শনী। এছাড়া অনুষ্ঠিত হবে মাস্টারক্লাস। অন্যদিকে ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকার লা গ্যালারিতে চলছে একটি বিশেষ শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ‘পার্সপেকটিভ : অ্যা কনটেম্পোরারি গ্রুপ আর্ট এক্সিবিশন’।
মন্তব্য করুন