কণ্ঠশিল্পী মনির খান। আসন্ন নির্বাচনে মনোনয়ন নেওয়ার গুঞ্জন চাউর হয়েছে তার নামে। একটা সময় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিলেন এই গায়ক। রাজনীতিতে আসার পর তার সংগীত ও ব্যক্তি জীবনের বাঁক বদলের নানা বিষয়ে জানতে কৌতূহলী হয়ে ওঠে কালবেলা। সম্প্রতি কালবেলাকে নিজের রাজনীতি ও সংগীত জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে জানিয়েছেন এই সংগীতশিল্পী।
কালবেলা : শোনা যাচ্ছে, আপনার এলাকা থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন। এটি কতটা সত্য?
মনির খান : বাংলাদেশের কিছু মানুষ জন্মেছে অপপ্রচার করার জন্য। কিছু মানুষের মাথায় শুরু থেকেই পচন ধরে আছে। যারা সত্যকে সত্য বলতে পারে না, যারা নীতির কাছে বা নিজের সত্যতার কাছে কখনোই নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে পারে না, এরকম কিছু নোংরা মানুষ, কিছু নষ্ট মানুষ এই সমাজে বিরাজ করছে। আমার মহেশপুর কোটচাঁদপুর মিলে একটি সংসদীয় আসন; ঝিনাইদহ-৩। আপনি জানেন, আমি খুব সক্রিয়ভাবেই বিএনপি করতাম। ২০১৮ সালের নির্বাচনে একটু ঝামেলা হওয়ার কারণে সেখান থেকে আমি একটু দূরে ছিলাম। যেহেতু গানে আমার বিশাল একটা জায়গা ছিল, সেই জায়গাতেই আমি ফিরে এসে আবার সক্রিয়ভাবে গান করছি। আল্লাহ পাকের হুকুমে মানুষের কাছে সমানভাবে আবারও শিল্পী হিসেবে দাঁড়িয়েছি। আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি। দল যদি নির্বাচনে না যায়, তাহলে আমার তো নির্বাচনে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। আমাদের এলাকায় কিছু মানুষ আছে, তারা অপপ্রচারে বিশ্বাসী। তারা মানুষকে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলে আনন্দ পায়। ঠিক তারই একটি কৌশল মাত্র। আমি জোর দিয়ে বলছি—আমি কোনো নমিনেশন পেপার তুলিনি, কোনো নমিনেশন পেপার নিইনি। অনেকে বলছেন তৃণমূল বিএনপি থেকে আমি নাকি নমিনেশন কিনেছি, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভুল। সম্পূর্ণ বানোয়াট একটি কথা। যারা অপপ্রচার চালিয়েছে তারা সমাজের কাছে খারাপ, দেশের কাছে খারাপ, নিজের পরিবারের কাছেও খারাপ। যারা এ কাজটি করছে তারা নিজের কাছেও নিজে খারাপ। ভালো কাজ করার ক্ষমতা, যোগ্যতা বা সাহস, কোনো কিছুই নেই। এরা কাপুরুষ।
কালবেলা : এদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে চিন্তা করছেন কি না?
মনির খান : একটা সুস্থ মানুষ হলে তার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করা যায়। একটা সুস্থ মানুষের সঙ্গে একটা সুস্থ চিন্তার যুদ্ধ হতে পারে। অসুস্থ মানুষের সঙ্গে কী করে যুদ্ধ করব! তারা তো এমনিতেই কাপুরুষ। তারা যদি সুপুরুষ হয়ে আসত, তাহলে সাথে যুদ্ধ করে মজা পেতাম। এই যুদ্ধ করার তো কোনো মানে হয় না। তা ছাড়া সাধারণ মানুষ এখন সচেতন। ফেসবুক, ইউটিউব, বিভিন্ন মাধ্যমে মানুষ সঠিক তথ্য পেয়ে যাচ্ছে। বিভ্রান্তিকর তথ্য পাচ্ছে, সঠিক তথ্যও পাচ্ছে। এতক্ষণ পর্যন্ত তারা আমার কাছে কিছু পাননি। আমি চুপ করে ছিলাম, দেখি কতদূর যায়। যখন মনে করলাম এটার জন্য একটি সঠিক বার্তা দেওয়া প্রয়োজন, ঠিক তখনই কিন্তু আমি সেই বার্তা দিয়েছি। ছোট একটা ভিডিও গতকাল থেকেই এলাকায় প্রচার হচ্ছে। অনেক মানুষই সত্যটা জানতে পারছে সেটা দেখে। ওরা চুপ হয়ে গেছে। গতকাল পর্যন্ত যেভাবে ফোন এসেছে আজ কিন্তু সেভাবে ফোন আসেনি। তারমানে মানুষ বুঝে ফেলেছে ওটা মিথ্যা, ওটা সত্য নয়।
কালবেলা : ২০১৮ সালে আপনি বলেছেন— আর কখনো রাজনীতিতে আসবেন না। রাজনীতি করবেন না—এরকম একটি কথা ছিল। এখন আবারও কি রাজনীতিতে আসার ইচ্ছা আছে?
মনির খান : আমি রাজনীতি করব না— এ কথা কিন্তু চিৎকার করে বলিনি। আমি বলেছি, আমি নিজে ব্যর্থ। আমার যেহেতু গানের বৃহৎ একটি জায়গা রয়েছে, আমি গানের জগতে ফিরে এসেছি। পরিস্থিতি বলে দেবে আমি কী করব। তখন আমি বলেছিলাম এটা। আমি সেই সিদ্ধান্তেই আছি।
কালবেলা : তাহলে আমরা বলতে পারি যে আগামীতে আপনার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা আছে…
মনির খান : দেশের স্বার্থে, সুষ্ঠু সমাজ গঠনে স্বার্থে, যদি আমার কোনো ভূমিকার প্রয়োজন হয় অবশ্যই আমি সেখানে একটি যোদ্ধা হিসেবে কাজ করব। এটা আপনার আমার সবারই নৈতিক দায়িত্ব। অসুস্থ পরিবেশকে সুস্থ করার জন্য যে যেখান থেকে পারি, দল থেকে হোক বা ব্যক্তিগত উদ্যোগ থেকে হোক, এটা সবারই দায়িত্ব যে ভালো কিছু করার জন্য এগিয়ে আসা।
কালবেলা : রাজনীতিতে আসার কারণে আপনার ক্যারিয়ারে কোনো ভাটা পড়েছে কি না? কিংবা ক্ষতি হয়েছে কি না?
মনির খান : চলমান একটি জায়গা থেকে আপনি যদি নতুন একটি জায়গায় যুক্ত হন, অবশ্যই সেই জায়গাটাকে স্টাবলিশ করতে গেলে চলমান জায়গাটার কিছু না কিছু ক্ষতি হয়। সেটা আমার হয়েছে। তবে আমি সবার দোয়ায় সংগীতে সেই জায়গাটি কিন্তু ফিরে পেয়েছি।
কালবেলা : রাজনীতিতে যাওয়ার কারণে আপনার গানের যে শ্রোতারা ছিলেন, তারা কি বিভক্ত হয়ে গেছেন?
মনির খান : তখন আমার কাছে অনেক এসএমএস আসত। অনেক ফোন আসত। বাংলাদেশে অনেকগুলো দল আছে। বিভিন্ন দলের মানুষ বিভিন্নভাবেই আমাকে বলেছেন, আপনি এটা ভুল করেছেন। আমি আপনার গান শুনতাম, আমি এই দল করি, আজকে থেকে আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে, তারপরেও নীরবে আপনার গান শুনব—এরকম কথা আমার কাছে এসেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমি খুবই ভাগ্যবান, যখন বিএনপি করতাম, তখন কিন্তু সব দলের প্রোগ্রামই করেছি। সরকারি দলের প্রোগ্রাম করেছি, সবাই কিন্তু আমাকে নিয়ে প্রোগ্রাম করিয়েছে। কারণ, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা কিংবা কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলা—এগুলো কিন্তু আমার নীতিতে নেই। আমার চরিত্রও এটি নেই। যে কারণে আমি সবার কাছেই আমাকে প্রিয় ব্যক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছি।
কালবেলা : আপনি কি মনে করেন রাজনীতিতে যাওয়ার কারণে আপনার সৃষ্টিশীল কাজ থেকে আপনার শ্রোতারা কিছুটা বঞ্চিত হয়েছেন?
মনির খান : এখানে একটা বিষয় আছে। আগে তো ছিল সিডি ও অডিওর যুগ। তখন ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা ও আমাদের পহেলা বৈশাখ—এই ৩টি ছিল বছরের উল্লেখযোগ্য উৎসব। সে সময় আমরা কিন্তু ঘটা করে অ্যালবাম করতাম। সেই অ্যালবামের যুগ বা অ্যালবামের যৌবন যখন শেষ হয়ে গেল, তখন এলো মেমোরি কার্ড, পেনড্রাইভ। মোবাইলে ডাউনলোড করা, ডিজিটাল মাধ্যমে শুরু হয়ে গেল। তখন আমাদের ম্যানুয়াল ব্যাপারটা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গেল। তখন ৪-৫ বছর ধরে কিন্তু আমরা কে দল করছি, সেটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যম তৈরি হলো। ঠিক ওই ৪-৫ বছর আমি রাজনীতিতে ছিলাম। ওই সময়টাতে অনেকে চাইলেও কিছু সৃষ্টি করতে পারেননি। সেক্ষেত্রে আমি খুব ভাগ্যবান। ওই গ্যাপটাতেই আমি পলিটিক্স করেছি। যে কারণে আমার শ্রোতারা সৃষ্টির থেকে বঞ্চিত হননি।
কালবেলা : অনেকে বলছেন শিল্পীরা রাজনীতিতে এলে দর্শকের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়, আপনার ক্ষেত্রে কি সেটা হয়েছে?
মনির খান : এটা আমার ক্ষেত্রে হয়নি। কারণ আমি ছিলাম অডিও ও সিডির যুগের শিল্পী। এখন কিন্তু ইউটিউরেব যুগ। আমার দুটি চ্যানেল আছে। আমি যে কোনো গান আপলোড করলে, সেই গান কিন্তু প্রচুর সাড়া পায়। আমি গান করি খুব বেছে বেছে। আমি কিন্তু হরহামেশাই যা পাই, তা-ই গাই না। তাই সংগীতের ক্ষেত্রে বলব, আমি খুব ভালো অবস্থানে আছি। যেটা বললেন যে শিল্পীরা রাজনীতিতে গেলে শ্রোতাদের কাছে তিনি কিছুটা ভাটা পড়েন; পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কথা চিন্তা করুন। তাদের কোনো শিল্পী, কোনো অভিনেতা, কোনো লেখক কি রাজনীতির বাইরে আছেন? তারা কোনো না কোনা দলের হয়েছে মন্ত্রী হচ্ছেন বা এমপি হচ্ছেন। কিংবা তার দল করছেন। কেন করছেন? কারণ তারা হচ্ছেন মানুষের প্রিয় মানুষ। তাদের মুখ থেকে দেশের পক্ষে কথা বেরোলে জনগণ তা শোনে। তাই আমার মনে হয় এটারও দরকার আছে।
কালবেলা : দশকের কাছে সংগীতশিল্পী হিসেবে মনির খান যেভাবে পৌঁছেছেন, একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে সেভাবে পৌঁছাতে পেরেছেন কি?
মনির খান : আমি তো মাঝখানে বিরতি দিয়েছি। এটায় তো লেগে থাকার ব্যাপার আছে। আমি তো শিল্পী একদিনে হইনি। বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত মানুষের শিকড় পর্যন্ত পৌঁছাতে গেলে সেটা সময়ের ব্যাপার। এটা লেগে থাকার ব্যাপার। তবে অন্যান্যদের ক্ষেত্রে অনেক দেরি হয়, কিন্তু আমি যে রাজনীতি করতাম—এটা সবাই জানে। সে ক্ষেত্রে আমি বলব যে, আমি এক্ষেত্রে একেবারেই ব্যর্থ না।
কালবেলা : শিল্পী তো দর্শকের চাহিদা বোঝে। তো রাজনীতিতে আসার পর তারা কি বুঝতে পারেন যে আসলে তাদের কাছে জনগণ কী চাইছে?
মনির খান : একজন শিল্পী, অভিনেতা বা একজন লেখক, যেটাই বলি না কেন, আমাদের কিন্তু কিছু করার ইচ্ছা থাকলে আমরা পারি না। কারণ একটা প্ল্যাটফর্ম লাগে। আমার কাছে সুর ছাড়া দেওয়ার আর কীইবা আছে! আমি চাইলেই তো অনেক কিছু করতে পারছি না। হয়তো আমি গোপনে সামান্য সাহায্য করতে পারি মানুষকে। কিন্তু বৃহৎ আকারে করা সম্ভব নয়। মানুষের জন্য বৃহৎ আকারে কিছু করতে গেলে একটা ভালো প্ল্যাটফর্মের দরকার হয়। প্ল্যাটফর্ম ছাড়া মানুষকে ভালোবাসা এবং ভালোবেসে দেওয়ার সুযোগ থাকে না।
(অনুলিখন : শিবলী আহমেদ)
মন্তব্য করুন