শিল্পী হওয়ার মহাযাত্রায় সারথি হতে চান অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনা। প্রতিটি মুহূর্তে জীবনে যোগ করে নিচ্ছেন নব্য পাথেয়। এই রুপালি জগতে ‘আই ক্যান্ডি’ হয়ে থাকায় ভীষণ অনীহা তার। রয়েছে নিজস্ব দর্শন ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। তার অধ্যবসায়, শিল্পচর্চা, কাজ ও দর্শন নিয়ে কথা হয় কালবেলার।
কালবেলা : অভিনয়ে সুনাম অর্জন করেও পড়াশোনায় বেশ সিরিয়াস দেখা গেছে আপনাকে। এত ব্যস্ততার মধ্যেও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার পেছনে আপনার বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য আছে কি?
আশনা হাবিব ভাবনা : বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য আসলে নেই। আমার ব্যাক অফ দ্য মাইন্ড এটা মাথায় ছিল—একজন অভিনয়শিল্পীকে সোসাইটি ভিন্নভাবে দেখে; সমাজের অন্য মানুষ আঙুল তোলে যে অভিনয়শিল্পীরা পড়াশোনা করেন না কিংবা গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হয় না; হলেও তারপর উচ্চশিক্ষার বিষয়ে তারা মনোযোগী থাকে না। এটা সমাজের মানুষের ধারণা; যদিও এটা সত্য নয়।
আমার ক্যারিয়ার যেহেতু অ্যাকটিং, তাই আমার কাজ হচ্ছে মানুষের সামনে আসা। আমি এমন কোনো অভিনয়শিল্পী হতে চাই না যিনি পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী নয় অথবা যার পড়াশোনা নেই, জিরো। আমি এমন কোনো অভিনয়শিল্পী হতে চাই না যাকে দেখে আরেকজন ইন্সপায়ার্ড হবে না।
আমার কাছে সব সময় মনে হয় পড়াশোনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। শুধু গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে ফেললাম, সেটা নয়। পড়াশোনার জন্য প্রতিটি দিনই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন আমি প্রতিদিন পড়াশোনা করি। বই পড়ি, কিছু না কিছু পড়তেই থাকি। আমার মনে হয় মানুষের জীবনে জ্ঞানের শেষ নেই। যদি আপনি জ্ঞান আহরণ করতে চান, পড়াশোনা করতেই হবে। এ ছাড়া কোনো উপায় নেই।
কালবেলা : আপনি লেখালেখিও করেন। এ জন্য আনেক বেশি পড়াশোনার প্রয়োজন। বইয়ের সঙ্গে আপনার মিতালি কতটা?
আশনা হাবিব ভাবনা : যারা বই পছন্দ করেন তারা সারাক্ষণই কিছু না কিছু পড়তে থাকেন। লেখালেখি আপনি তখনই করতে পারবেন যখন বইয়ের সঙ্গে আপনার একটা প্রেম থাকবে। মানে বই পড়ে আপনি লেখক হবেন—বিষয়টা তা নয়। বিষয়টা হচ্ছে, আপনি যখন অনেক বই পড়বেন, অনেক পেইন্টিং দেখবেন, মিউজিক শুনবেন, তখনই তো আর্টের অন্যান্য মাধ্যমে আপনার বিচরণ হবে; তখনই তো শিল্প চর্চাটা আপনি নানাভাবে করতে চাইবেন।
কালবেলা : আর্টের নানা শাখায় আপনাকেও ঢুঁ দিতে দেখা যায়। এটি ঠিক কোন তাড়নায়?
আশনা হাবিব ভাবনা : কোন তাড়নায় সেটা হয়তো গুছিয়ে বলতে পারব না। আমি নিজেই হয়তো জানি না। আমি আসলে শিল্পী হওয়ার যাত্রায় আছি। সে যাত্রাটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত। আমি প্রতিদিন আসলে একটু-একটু করে বদলাই; পরিবর্তন হয় আমার। প্রতিদিনই কিছু যোগ হয়। একেকটা দিন আসলে একেকটা নতুন জীবন। নতুন সময়, নতুন লেখা, নতুন কবিতা, ছবি আঁকা, অনেক কিছু যুক্ত হয়ে যায় জীবনে। আমার ভালো লাগে সেটা। গান, নাচ, কবিতা আবৃত্তি, পেইন্টিংসহ শিল্পের সব শাখায় যদি বিচরণ করতে পারতাম, তাহলে হয়তো আরও ভালো লাগত। ছবি আঁকা আমাকে অনেক আনন্দ দেয়। যদিও নিয়মিত আঁকতে পারি না। আবার যখন শুরু করি, তখন দেখা যায় একটানা ছবিই আঁকছি। যে কাজটা আমাকে আনন্দ দেয়, সেটি করতে পছন্দ করি। তা দিয়ে যদি উপার্জন হয় হয়, তাহলে তো মনে হয় আমার চেয়ে সাকসেসফুল আর কেউ নেই।
কালবেলা : আপনাকে ঠিক বাণিজ্যিক ঘরানার গৎবাঁধা সিনেমায় দেখা যায় না। বড়পর্দায় আপনার চরিত্রগুলো একটু ভিন্ন ধাঁচের। এই আলাদা ঘরানা কি আপনিই বেছে নেন, নাকি তেমন চরিত্রে পরিচালকরাই আপনাকে নিয়ে থাকেন?
আশনা হাবিব ভাবনা : আমার কাছে সব সিনেমাই আসলে বাণিজ্যিক। কোনো চলচ্চিত্রই টাকা ছাড়া নির্মিত হয় না। যে সিনেমায় টাকা ঢালা হয়, প্রডিউসার অবশ্যই চাইবে সেই ফিল্ম যেন ব্যবসা করে। আমি অভিনয়শিল্পী হতে চাই। সেটা হওয়ার জন্য আমাকে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করতে হবে— এটাই সবচেয়ে বড় কথা। অভিনয়শিল্পী হিসেবে আমি ভীষণ লোভী। আমি এমন কোনো সিনেমায় কাজ করতে চাই না যেখানে আমি শুধু একজন নায়িকা, আমার দুইটা গান, ব্যস। অভিনয়শিল্পী হিসেবে আমি আরও বেশি কিছু চাই। আমার চরিত্রের যদি গুরুত্ব না থাকে, তাহলে আমি শুধু ‘আই ক্যান্ডি’ হয়ে অভিনয় করতে চাই না। অভিনয়শিল্পী হিসেবে সেটা আমার লক্ষ্য নয়। তা ছাড়া সেটা আমাকে ভীষণ অসম্মান বোধ দেয়; অনুভব হয় যে আমার কিছু করার নেই, হিরোই অল ইন অল, আমি শুধু নায়িকা, শুধু একটু কাঁদলাম আর দুটি গানে অভিনয় করলাম, এটুকুই। আমাদের দেশে অথবা সাব-কন্টিনেন্টে দেখবেন—এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেয়েদের জন্য এমন চরিত্র আবিষ্কার করে রেখেছে যেখানে একজন নারী অভিনেত্রী হচ্ছেন একজন পুরুষ অভিনেতার মা, নয়তো বউ, নয়তো প্রেমিকা, এটুকুই। ওই নারী কখনোই চরিত্র হয়ে ওঠেন না। কিন্তু আমি খুবই খুশি যে আমার অল্প ক্যারিয়ারে যেসব সিনেমা আমি করেছি, সেখানে আমি চরিত্র পেয়েছি এবং সেই চরিত্র হওয়ার চেষ্টা করতে পেরেছি।
কালবেলা : আপনার দর্শনগত জায়গা থেকে জানতে চাই—অভিনয়শিল্পে ‘মঞ্চ চর্চা’ কতটা দরকারি? দুর্দান্ত অভিনয়শিল্পীরা যেমন মঞ্চ থেকে এসেছেন, এর বাইরে থেকে আসারও নজির রয়েছে…
আশনা হাবিব ভাবনা : দর্শনগত জায়গা থেকে আমি বিশ্বাস করি— যেই কাজ থেকে আমি উপার্জন করছি, সেটা সম্পর্কে আমার যথাযথ জ্ঞান থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মঞ্চে অভিনয় করেই সবাই ভালো অভিনয়শিল্পী হবেন, এমন কথা নেই। অনেকে মঞ্চে দুর্দান্ত, কিন্তু তাদের অনেকে স্ক্রিনে এসে ফেল করেছেন। সাকসেসফুল হওয়ার জন্য ভালো অভিনেতা হওয়ার দরকার নেই; এটা একটা অন্য গল্প। দর্শকের বিচারে সে হয়তো ভালো অভিনেতা। ভালো ও খারাপ তো আসলে খুব আপেক্ষিক। আপনার কাছে যেটা ভালো, সেটা আমার কাছে ভালো নাও লাগতে পারে। আমার কাছে যেটাকে রাইট মনে হচ্ছে, সেটা আরেকজনের কাছে পুরোপুরি ভুল মনে হতে পারে। তাই অভিনয় করার জন্য কী জরুরি আর কী জরুরি নয়, সেটা আসলে একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি কেবল আমারটা বলতে পারব যে—আমি লাস্ট তিন বছর সৈয়দ জামিল আহমেদ-এর কাছে অভিনয়ের তালিম নিয়েছি। আমার মনে হয় এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি অভিনয়কে আমার মতো করে পেতে চেয়েছি। আমি মনে করেছি অভিনয় সম্পর্কে আমার জ্ঞান অনেক স্বল্প; আমার অভিনয়টাকে ঠিক করতে চাই, আমি ভালো অভিনয়শিল্পী হতে চাই। ভালো অভিনয়শিল্পী হওয়ার জন্য যা যা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা আমি করতে চাই। তাই আমি জামিল স্যারের কাছে একের পর এক ওয়ার্কশপ করেছি, অভিনয়টা জানার চেষ্টা করেছি। এখনও আমি সেটা জারি রেখেছি। আমি মঞ্চেও অভিনয় করেছি, জামিল স্যারের ডিরেকশনে। তাই এটাকে আমার জন্য খুব জরুরি মনে হয়। অভিনয়শিল্পীদের জন্য জরুরি কিনা, সেটা আমি বলতে পারব না। সেটা বলার আমি কেউ না। সেটা আমি বলতেও চাই না। কিন্তু আমার জন্য ডেফিনেটলি অনেক জরুরি। স্টেজ আমার জন্য ছোটবেলা থেকেই খুব জরুরি। কারণ আমি একজন ক্লাসিক্যাল ডান্সার। স্টেজ আমার ক্যারিয়ারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমি যখন স্টেজে পারফর্ম করি, তখন যে অনুভূতিটা পাই, এটা আসলে সবকিছুর চাইতে আলাদা।
কালবেলা : নাচ নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
আশনা হাবিব ভাবনা : নাচ নিয়ে আমার ভবিষ্যতে সে রকম কোনো পরিকল্পনা নেই। এমনিতে আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব একটা ভাবি না। যখন নাচের ভালো কোনো শো আমি পাই, তখন শো করি। মাঝেমধ্যে আমি নাচের বিভিন্ন জিনিস শুট করি। একটি পোয়েটিক্যাল ফিল্ম করেছিলাম। সেখানে আমি নিজে কবিতা আবৃত্তি করেছি, নেচেছিও। এরকম কিছু কাজ মাঝে মধ্যে চলে আসে। কিন্তু অতটা পরিকল্পনা করে নয়।
কালবেলা : সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলতে একটি কথা রয়েছে। এক জাতি অন্য জাতির ওপর তার সংস্কৃতি আরোপে নানান কৌশল করে। তারকারা কি পশ্চিমা বা ভিনদেশি সংস্কৃতির বাহক?
আশনা হাবিব ভাবনা : দেখুন আমাদের ভেতরে যে কলোনিয়াল অ্যাটিটিউড আছে, সেটা তো আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে থাকি। তাই আমার মনে হয় পশ্চিমা কালচার বা এসবের চেয়ে আমরা যদি নিজেদের ভেতর দেশপ্রেমটাকে জাগ্রত করতে পারি, তখন আমাদের সংস্কৃতির উন্নতি হবে। তখন আমাদের গল্প আমরা বলতে পারব। এখন পাশের দেশে থ্রিলার হচ্ছে বলে আমাদেরও ওটিটিতে থ্রিলার বানাতে হবে, বিষয়টি তো তা নয়। আমি আমার দেশের জন্য একটু অন্যরকমভাবে ভাবতেই তো পারি; আমার দেশের ছবি আমার মতো করে হবে। পাশের দেশেও দেখবেন—বলিউডে যে রকম কমার্শিয়াল সিনেমা হয়, তামিলের কমার্শিয়াল সিনেমার কিন্তু আলাদা একটা ভাষা আছে, আলাদা একটা যাত্রা আছে। ওই জায়গা থেকে আমার মনে হয় আমাদের উচিত আমাদের গল্প বলা; আমাদের উচিত আমাদের সিনেমা বানানো, আমাদের কবিতা লেখা, আমাদের বিষয় নিয়ে ছবি আঁকা। আপনার কিন্তু আগে আপনার বাসার মানুষকে দেখতে হবে। প্রথমেই প্রতিবেশীকে দেখতে পারবেন না। প্রথমে আপনি আপনার দেশকে দেখুন। প্রথমে দেশের জন্য কিছু করি, তারপর বাইরে। বিদেশ থেকে আপনি কিছু একটা অ্যাওয়ার্ড নিয়ে আসেন, বিদেশে যদি আপনি একটা ছোট চরিত্রেও কাজ করতে পারেন, সেটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়! এর কারণ আমাদের কলোনিয়াল অ্যাটিটিউড!
কালবেলা : বলা হয়—তারকার পরিচয় অরাজনৈতিক। তারকার আদর্শ নয়, পর্দায় তার কাজটিকেই প্রাধান্য দিতে বলা হয় দর্শকদের। কিন্তু বিশ্বের নানান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কিছু তারকা কখনো কখনো রাজেনৈতিক পরিচয় ধারণ করেন। বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
আশনা হাবিব ভাবনা : অন্যদের উত্তর আমি দিতে পছন্দ করি না। আমি কেবল আমার উত্তর দিতে পারব। আমার মনে হয় প্রত্যেকটা মানুষ রাজনৈতিক। সেটা শুধু রাজনীতি করতে হবে বলে না। আপনি কিন্তু আপনার বাড়ির ভেতরেও রাজনীতি করেন। এবং আপনি আপনার রাজনীতির বিষয়ে কিন্তু একদম ছোটবেলা থেকেই সচেতন। সেটা এমন নয় যে আপনি কোন পার্টিকে ভোট দেবেন, নট লাইক দ্যাট। আপনাকে রাজনীতি করেই জীবনে চলতে হয় আসলে। সেটা যেভাবেই হোক না কেন। আপনার বাড়ির ভেতর থেকেই শুরু হয় আপনার রাজনীতি। আমার মনে হয়, রাজনীতির বিষয়ে আমরা ছোটবেলা থেকেই ভীষণ সচেতন থাকি। তারকাদের মানুষ পছন্দ করে, এটা তো সঠিক। এখন আমাকে যদি মানুষ পছন্দ করে, মানুষ পছন্দ করে যদি আমাকে তারকা বানায়, তারপর তারা যদি পছন্দ করে আমাকে তাদের মুখপাত্র বানায়, সো ফাইন; কেন নয়! তারকারাও তো ইন্ডিভিজুয়াল মানুষ। তাদের তো ব্যক্তিগত পছন্দ থাকতে পারে। তারা ব্যক্তিগত কোনো দল করতেই পারেন।
কালবেলা : বর্তমানে আপনি কোন কোন সিনেমা বা নাটক নিয়ে নিয়ে ব্যস্ত?
আশনা হাবিব ভাবনা : নাটকের সঙ্গে আমি অনেক বছর ধরে নেই। আমি সিনেমাটি করছি। তিনটি সিনেমার কাজ আমার রেডি হচ্ছে একসাথে— ‘দামপাড়া’, ‘যাপিত জীবন’ ও ‘পায়েল’। সিনেমা নিয়েই আছি।
মন্তব্য করুন