সততা ও পরিশ্রমের মিশেলে গড়ে ওঠা একজন অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন। ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবিতে অভিনয় করে দর্শক হৃদয়ে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছেন। ‘খুফিয়া’র মাধ্যমে নিজেকে বিস্তার করেছেন বলিউডে। প্রশংসায় গা ভাসিয়ে যেমন নিজের অস্তিত্বকে ভোলেন না, তেমনই গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণে সদা প্রস্তুত রয়েছেন বাঁধন। তার পরিশ্রম ও সততাকে কাজে লাগানো হোক, এটাই অভিনেত্রীর কামনা। বাঁধন তার কাজ, জীবনদর্শন, আনন্দ ও যাপিত জীবনের কিছু ফিরিস্তি ভাগ করেছেন কালবেলায়।
কালবেলা : পরিবর্তিত এক বাঁধন আপনি। এই পরিবর্তনের মূল হাতিয়ার কী? জেদ, নাকি পুরোটাই ভাগ্য? যদি ‘জেদ’ হয়, তাহলে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করে সফলতা আনলেন কীভাবে? জেদ তো মানুষকে কখনো কখনো ধ্বংসও করে।
বাঁধন : আপনি যে দুটি ধারণা করেছেন, একটিও সঠিক নয়। জেদ একেবারেই না, ভাগ্য কিছুটা তো আছেই। ভাগ্য অবশ্যই আছে। আমার পরিবর্তন ও পথচলার মূল চালিকাশক্তি আমার সততা, পরিশ্রম ও আমার নিয়ত। এমন নয় যে আমি খুব বেশি ধর্ম চর্চা করি। তবে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি— জীবনে কী হবে কিংবা আপনি কী রেজাল্ট পাবেন, সেটা আসলে আপনার নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। নিয়তের ওপর আমার সবসময় ভরসা ছিল। মনে হয় এটাই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি; তারপর অবশ্যই আমার সততা ও পরিশ্রম। আমি ভীষণ পরিশ্রমী ও সৎ। আমার নিয়ত সবসময় পরিষ্কার। আমি কখনো কারো খারাপ চাইনি; কখনো কারো খারাপ করিনি। আমার সঙ্গে যখনই খারাপ কিছু ঘটেছে, আমি দেখেছি— নেচার হোক, আমার সৃষ্টিকর্তা হোক, সেটা কোনো একটা ইস্পিরিচুয়াল পাওয়ার হোক, কোনো না কোনোভাবে আমি সেই জায়গা থেকে বের হয়েছি কিংবা সেই শক্তিটা আমার ভেতর কাজ করেছে। ডেফিনেটলি সেগুলো আমার এই পরিবর্তনের ও পথচলাতে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
কালবেলা : সুসময়ে বন্ধু বাড়ে। বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে— আপনার সুসময় চলছে। যাদের একসময় ডেকেও পাননি, তারা কি এখন কাছে এসে আপন হতে চাইছে?
বাঁধন : ওই অর্থে বন্ধু বাড়ছে না, আমার বন্ধু কমছে। আমার আশপাশ, বন্ধুত্ব ও যে কোনো সম্পর্ককে আগে যেভাবে বিশ্লেষণ করতাম, যেভাবে দেখতাম, সেটার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সেই সংজ্ঞা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। ডেফিনেটলি আপনি যখন সাফল্য পাবেন, যখন ভালো থাকবেন, তখন আপনার আশপাশের সবাই আপনাকে ভালো বলবে, আপনার সব মুভমেন্ট ও ডিসিশনকে তারা অ্যাপ্রসিয়েট করবে। এটা শুধু আমার ক্ষেত্রে না, সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যে বিষয়গুলো বেশির ভাগ জায়গায় সমাদৃত, তেমন কিছু যখন কেউ না করে, তখন তাকে সাপোর্ট করার মানুষ খুব কম থাকে। যেটা আমি ফেস করে এসেছি আমার জীবনে। আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে– জীবনের ৯০ শতাংশ সময়ে শুনেছি— আমি যা করছি তা ঠিক করছি না। এটা শুনতে-শুনতেই আমার বড় হওয়া। আমি যখন যে পদক্ষেপ নিয়েছি, সেটা যেহেতু সমাজের তথাকথিত অন্য মানুষের চিন্তার সঙ্গে মিলছে না, তাই প্রথমে সবাই এক ধরনের ডিফেন্সিভ মুডে থাকেন। এ ব্যাপারে আমি কাউকে দোষ দিচ্ছি না; এটা নিজেদের বাঁচানোর একটি প্রক্রিয়া। মানুষ সাধারণত ওই মানুষটার সঙ্গে কিংবা ওই ডিসিশনটার সাথে থাকে না, যেটা প্রচলিত নিয়ম, চিন্তা ও ধারার বাইরে। আমার জীবনের যে সিদ্ধান্তগুলো আমি নিয়েছি, সেটা সঠিক অথবা ভুল হোক, সবই আমি আমার মতো করে নিয়েছি। সেসব সিদ্ধান্তে আমার পাশে থাকাটা ভীষণ কঠিন। সেই কঠিন সময়েও আমি কিছু মানুষকে আমার পাশে পেয়েছি। আমি তাদের কাছে অনেক গ্রেটফুল। সেই মানুষগুলো আমার কাছে একদম পিওর সৌল, যারা তাদের প্রতিকূলতা ও দ্বিধাদ্বন্দ্বের মাঝেও আমার পাশে থেকে সাহস দিয়েছেন। আমি কখনোই বলব না যে, আমার পথটা কেউ চালিয়ে দিয়েছেন। আমার সিদ্ধান্ত কিংবা যে পথ আমি নির্ধারণ করেছি, সেই পথ চলতে তারা আমার পাশে থেকে সাপোর্ট করেছেন। সেটা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষ। একই মানুষ নিরবচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন ডিসিশনে আমার পাশে থাকতে পারেননি; সেটা সম্ভবও না। কারণ আমার একেকটি সময় ও পরিস্থিতিতে আমার একেক ধরনের সিদ্ধান্ত ছিল। ওই সময়ে নতুন-নতুন মানুষকে আমার পাশে পেয়েছি। এমন পিওর সৌলদের পেয়েছি যারা ওই সময়টুকুতেই আমার পাশে থেকে সাপোর্ট দিয়েছেন। তাদের সঙ্গে হয়তো আমার সেই অর্থে যোগাযোগ নেই; কিন্তু ডেফিনেটলি আমার সঙ্গে যখনই ভালো কিছু হয়, সেই ব্লেসিং তাদের জন্যও বরাদ্দ। আমার সঙ্গে যা কিছু ভালো হবে, অবশ্যই সেগুলোর ভাগীদার সেই মানুষজন, যারা আমাকে সাপোর্ট করেছেন।
কালবেলা : ঢালিউড ও বলিউডে প্রশংসিত আপনি। প্রশংসা অনেক সময় প্রতিভাবিনাশী। প্রশংসা আপনার অভিনয় দক্ষতার ওপর প্রভাব ফেলবে না তো?
বাঁধন : আমি আমার জীবনে অ্যাপ্রিসিয়েশন কম পেয়েছি। সবসময়ই হিউমিলিয়েটেড ও বুলিড হয়েছি। অভিনয় একদমই পারি না—সেটা শুনে-শুনেই এত বছর পার করেছি। ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ আমাকে যা দিয়েছে, এরপর আমি যদি আমার কাজটাকে এভাবে চালিয়ে যেতে পারি, আমার মনে হয় না—এরপরে এমন কোনো প্রশংসা ও অ্যাচিভমেন্ট আমাকে ওইভাবে আন্দোলিত করবে; অথবা এমন একটা সিচুয়েশনে ফেলবে যে—আমি আসলে এটা ভুলে যাব যে—প্রতিটা মুহূর্তেই আমার শেখার এবং নিজেকে বিকশিত করার অপশন আছে। সেই জায়গাতে আমি অনেক পরিষ্কার। মানুষ হিসেবে যেহেতু আমার নতুন এক ধরনের উপলব্ধি তৈরি হয়েছে, সেই জায়গা থেকে প্রশংসা আমাকে এক ধরনের ভালো লাগা দেয়; কিন্তু খুব বেশি প্রশংসায় যে আমি একেবারে উদ্বেলিত হয়ে গা ভাসিয়ে নিজের অস্তিত্বকে ভুলে যাই, সেটা নয়। রেহানা মরিয়াম নূর শুধু বাংলাদেশই নয়, পুরো সাব-কন্টিনেন্টের একটা অন্যতম ভালো ছবি। আমি ‘এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছি; পুরো এশিয়ার মধ্যে বেস্ট অ্যাকট্রেস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি, সেটাকে ছাপিয়ে তো আমার এখনো কোনো অর্জন হয়নি। আমার ‘খুফিয়া’র রেসপন্স অত্যন্ত ভালো। বলিউডে আমাকে মানুষ চিনছে, এতে ভালোলাগা কাজ করছে; কিন্তু সেটা এমন নয় যে আমার রেহানা মরিয়াম নূর-এর অ্যাচিভমেন্ট ছাড়িয়ে গেছে; এটা কখনোই হয়নি। আমি ভীষণভাবে স্বশিক্ষিত ও সেনসেটিভ। আমার চারপাশের অবস্থান, আমার সামাজিক অবস্থান এবং নিজের অবস্থান, সবকিছুর ব্যাপারে খুবই সচেতন আমি। সেই জায়গা থেকে আমি আমার কাজটা করতে চাই। আমি পরিশ্রমটা করতে চাই, সততার সঙ্গে বাঁচতে চাই এবং মানুষ হতে চাই।
সবসময়ই বলি—আমার জীবনে ব্যর্থতা অনেক বেশি। আমি সবাইকে বলি, সফল হওয়ার মূল চাবিকাঠি হচ্ছে ব্যর্থ হওয়া। জীবনে যে যত বেশি ব্যর্থ হবে, তার সাফল্য তত বেশি মানুষকে ছুঁয়ে যাবে। যেটা আমি আমার জীবন থেকে দেখেছি। আমার জীবনে অনেক ব্যর্থতা। আমার হয়তো গুটিকয়েক সাফল্য ও সফলতা আছে। সেগুলো মানুষকে ছুঁয়ে যায়। কারণ তারা তাদের সঙ্গে আমাকে রিলেট করতে পারেন। আমি কোনো সুপারহিউম্যান-বিঙ কিংবা আয়রন লেডি নই। আমি রক্ত-মাংসের মানুষ। আমার জীবনে নানান ভুল ও প্রতিবন্ধকতা আছে। নানান অবিচারের শিকার হয়েছি। আমি নিজেও অনেক ভুল করেছি। তারপরেই কিছু সফলতা আমি পেয়েছি। তাই সবকিছুই আমি উপভোগ করতে চাই। সবকিছুকে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাই।
কালবেলা : নিজের অভিনয় দক্ষতাকে বাড়াতে আপনি কী কী করে থাকেন?
বাঁধন : যেহেতু থিয়েটার আমার ব্যাকগ্রাউন্ড না, তাই ওই ধরনের কোনো প্র্যাকটিস আমি জানি না যে কী করা যায়। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, একজন অভিনয়শিল্পীর সবার আগে অবজারভ করার ক্ষমতা থাকা উচিত। তাদের সেনসেটিভ হওয়া উচিত। যেটা আমি আগেও ছিলাম। কিন্তু এখন খুব ভেবেচিন্তে আমি এর প্র্যাকটিস করি। ফিল্ম দেখি, বই পড়ি, নতুন-নতুন জিনিস শেখার চেষ্টা করি। অভিনয়ের বিভিন্নরকম মাস্টার ক্লাস আছে, যেগুলো ইউটিউবে পাওয়া যায়। আমি সেগুলো দেখার চেষ্টা করি। বড়-বড় ডিরেক্টররা কীভাবে একজন অভিনয়শিল্পীর সঙ্গে ডিল করতে চান, সেটা জানার চেষ্টা করি। যে অভিনেত্রী আমার পছন্দ, তারা কীভাবে একটা ক্যারেক্টারকে ধারণ করেন, সেটা জানার চেষ্টা করি। আমার নিজের ক্যারেক্টারগুলোকে এনালাইসিসের চেষ্টা করি। যখন যেটা করব আমি সেটা একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে পারি। আমি সবাইকে বলি—আমি ভালো অভিনয় শিল্পী নই; আমি অনেক পরিশ্রমী ও সৎ। শুধু আমার এই দুটি জিনিস আপনারা কাজে লাগান। যারা আমাকে কাজে লাগাতে পারেন তাদের কাজ ক্লিক করে, যারা পারবেন না, তারা ব্যর্থ। এখানে আমার বেশি ক্রেডিট নেই, একসেপ্ট আমি পরিশ্রমী ও সৎ।
কালবেলা : আপনাকে ঘিরে জনসাধারণের মধ্যে কিছু সমালোচনা রয়েছে। ‘সমকামীতা’ বিষয়ক চরিত্রে অভিনয় করে সাধারণ দর্শকের কাছে সম্প্রতি সমালোচিত হয়েছেন। তারকা হিসেবে দর্শককে যেমন উপেক্ষা করা সম্ভব নয়, আবার দর্শকের সমালোচনাও অনেক সময় অযৌক্তিক হয়ে থাকে। আপনার ‘সমালোচক-দর্শকের’ গুরুত্ব আপনার কাছে কতটা?
বাঁধন : সমালোচনা বলে একটা বিষয় আছে, আপনি জানেন অবশ্যই। যারা আমার কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করে থাকেন, সেই আলোচনাকে সাদরে গ্রহণ করতে একেবারেই প্রস্তুত আমি। সেটা গ্রহণ করি। আপনি আমার ফেসবুক-ইন্সটাগ্রাম—এগুলোতে দেখবেন যারা গঠনমূলক সমালোচনা করেছেন, আমি তাদের অ্যাপ্রিশিয়েট করেছি; সেটা গ্রহণ করেছি। গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করার মতো সেনসেটিভ, প্রগ্রেসিভ ও সেন্সেবল হিউমান বিঙ আমি। আমি যথেষ্ট পড়াশোনা করেছি। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে আপডেট করার চেষ্টা করি। জনসাধারণের মধ্যে আমাকে নিয়ে সমালোচনার বিষয়টিকে আপনি যদি ‘ক্রিটিসিজম’ অর্থে বোঝান, সেটা যদি গঠনমূলক ক্রিটিসিজম হয়, সেটা সমালোচনা নয়। আপনি যেটাকে ইঙ্গিত করছেন, সেটা হচ্ছে একেবারে হেইট স্পিচ, হেইট সেন্টেন্স, হেইট মন্তব্য। সেটা তো আসলে যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কেউ যদি কাউকে হেইট করে কোনো স্পিচ অথবা স্টেটমেন্ট দেয়, কোন রকমের বাজে মন্তব্য করে, এটা একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটা তার মনন ও শিক্ষার ওপর নির্ভর করে। সেটার ওপর তো আমার হাত নেই। কে কী ধরনের মনন নিয়ে সমাজে বাস করবে, সেটার ওপর আমার কোনো হাত নেই। যারা আসলে অকথ্য ভাষায় বাজে মন্তব্য করেন, তাদের ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। কারণ সমালোচনা ও অকথ্য ভাষায় বাজে কথা বলার যে পার্থক্য, সেটা একজন সাংবাদিক হিসেবে আপনি জানেন। সাধারণ জনগণকেও এটা শেখাতে হবে যে অকথ্য ভাষায় মানুষকে বুলি করা ও গালি দেওয়া এবং সমালোচনা করা এক জিনিস না। ফিল্ম-ক্রিটিসিজম এবং বাজে কোনো সমালোচনা একেবারে ভিন্ন জিনিস। তাই এই শব্দটার সঙ্গে আমাদের দর্শকদের একটু পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিত। আমার একটা আলাদা দর্শক গ্রুপ আছে, সেই দর্শক আমি তৈরি করেছি। আমাকে যারা ভালোবাসেন, আমার কাজকে যারা ফলো করেন, তারা আমাকে আমার মতো করেই মেনে নিয়েছেন। আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটা হচ্ছে আমি নিজে। একজন অভিনেত্রী হওয়ার আগে আমি একজন মানুষ। মানুষ হিসেবে আমার স্বাধীনতা আছে। আমি আমার বুদ্ধি, মনন ও প্রজ্ঞা দিয়ে জীবনটাকে যেভাবে সাজাতে চাই, সেটা সাজাতে পারব। তেমনি একজন অভিনেত্রী হিসেবেও আমার সেই অধিকার আছে। আমার যে কাজটা করতে ভালো লাগবে, যে কাজটা আমাকে এক্সাইটেড করবে, সেই কাজটা আমি করব। তারপরে যে দর্শক আমাকে পছন্দ করবেন, তারা করবেন। যারা করবেন না, তারা করবেন না। কিন্তু সমালোচনা এক জিনিস আর মানুষকে অহেতুক অকথ্য ভাষায় যেকোনো রকমের স্টেটমেন্ট দেওয়া একেবারেই আলাদা বিষয়।
কালবেলা : বিতর্কিত চরিত্রে অভিনয় করে সমালোচিত হয়ে পরিচিতি বাড়ানো যায়। তাই বলে কোনো তারকা যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সব সময় সামাজিকভাবে বিতর্কিত চরিত্রগুলোতেই কাজ করতে চান কিংবা পরিচালকরা তাকে যদি সে ধরনের চরিত্রের জন্যই সিলেক্ট করেন, তাহলে সেই তারকার প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
বাঁধন : এই প্রশ্নটা কিছুটা লেইম। এই ধরনের প্রশ্ন এই যুগে সাংবাদিকরা করবেন বলে আশা করিনি। ‘বিতর্কিত’ চরিত্র বলতে কী বোঝাচ্ছেন আমি জানি না। চরিত্র চরিত্রই। যে কোনো চরিত্রই যদি একজন অভিনয়শিল্পীকে এক্সাইটেড করে, যদি সে মনে করে যে সে ওই চরিত্রটি করতে চায়, সে সেই চরিত্রটি করার অধিকার রাখে। ‘বিতর্কিত চরিত্র’ বলে আলাদা কোনো চরিত্র আছে বলে আমার জানা নেই। আমার জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সেটা নেই। যদি কারো কাছে থাকে, সেটা তার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু একজন সাংবাদিক হিসেবে ‘বিতর্কিত চরিত্র’ যে আছেই এটা কীভাবে বলছেন আমি জানি না। ‘সমালোচিত হয়ে পরিচিতি বাড়ানো যায়’—এগুলো খুব ব্যাকডেটেড চিন্তা। পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে। যখন চোখ মেলে পৃথিবীটা দেখবেন, তখন বুঝবেন আমরা কত ক্ষুদ্র। এ ধরনের চিন্তাও যে কতটা ক্ষুদ্রতার পরিচয়, সেটা অবশ্যই বুঝতে পারবেন। আমি মনে করি কাউকে পরামর্শ দেওয়ার ক্যাপাবিলিটি আমার নেই। আমি আমার নিজেকে পরামর্শ দিতে পারি। আমি নিজেকে যে পরামর্শ দিই সেটা হচ্ছে—একজন অভিনেত্রী হিসেবে আমার সেই স্বাধীনতা ও অধিকারও আছে যে আমি যেই চরিত্র করতে চাই, সেই চরিত্রই আমি করব। একজন মানুষ হিসেবেও আমার সেই অধিকার আছে যে আমি যেই পেশায় কাজ করছি, সেই পেশায় কাজ করতে গিয়ে আমি যাতে কোনো রকমের চাপের মুখে না পড়ি, কোনোরকম সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার না হই, কিংবা কোনো রকমের বুলিংয়ের শিকার না হই। যেমন ধরুন এই প্রশ্নটি। ‘বিতর্কিত চরিত্রে অভিনয় করে সমালোচিত হয়ে পরিচিতি বাড়ানো যায়’ এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন যেন আমি না হই। একজন মানুষ হিসেবে আমার অধিকার আছে—সমাজে আমি আমার জীবনকে আমার মতো করে যাপন করতে পারব। আশা করি বুঝতে পারবেন।
কালবেলা : বলিউড তারকাদের সান্নিধ্য পেয়েছেন আপনি। তাদের সঙ্গে ঢালিউডের আচরণ, কাজ, পরিবেশ ও কমিটমেন্টের কোনো পার্থক্য আপনার চোখে পড়েছে কি না?
বাঁধন : বিশাল ভরদ্বাজ বেশ কয়েকবার ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। তার কাজ অনেক আলাদা। সে যে মাপের ডিরেক্টর এবং টাবু যেই মাপের অভিনেত্রী, তাদের দুজনের সান্নিধ্যে গিয়ে আমি যেটা দেখেছি—তারা মাটির সঙ্গে মিশে থাকা মানুষ। আমি তাদের কাছে থেকে দেখেছি— তারা এত বড় হওয়ার পেছনে মূল কারণ তাদের সততা, ডেডিকেশন ও মানবিক হয়ে ওঠা। এটা আমার কাছে ভীষণ ভালো লেগেছে। কাজের পরিবেশ খুব স্বাভাবিকভাবে আলাদা। কারণ টাকা এখানে সম্পৃক্ত। বাজেট ওদের বেশি, ওদের মার্কেট অনেক বড়। তাই ওদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য তো হবেই, তাই না? আর কমিটমেন্টের বিষয়টাও টাকার সঙ্গে রিলেটেড অলমোস্ট। এমনিতেও সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে আমাদের প্রেক্ষাপটটা আলাদা। আমরা কিন্তু খুব বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত জাতি। যেহেতু দুর্নীতিটা সমাজের একটা ব্যাধি, সেটা মিডিয়াতেও আছে। সেই হিসাব যদি করি, তাহলে এখানে প্রচুর কথার গরমিল থাকে। কথার গরমিলের সঙ্গে রিলেটেড হয় তাদের কমিটমেন্ট, তাদের প্রফেশনালিজম, সবকিছু। ওই জায়গায় তো ঘাটতি কিছুটা আছেই।
কালবেলা : বলিউডের উন্নতি কি পুরোটাই বাজেটভিত্তিক?
বাঁধন : পুরোটা বাজেটভিত্তিক নয়। তবে বাজেট একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। মার্কেট একটা ইম্পরট্যান্ট ফ্যাক্টর। ওরা আসলে অনেক আগে থেকেই এই ইন্ডাস্ট্রি বিলং করছে। আমরা তো জাস্ট শুরু করেছি। ওদের সঙ্গে আসলে সেইভাবে আমাদের তুলনা করতে পারছি না। আমাদের এখানকার ইয়াং ছেলেমেয়েরা অনেক ট্যালেন্টেড। আমাদের এখানে যদি কোনো ইনস্টিটিউশন তৈরি করা যেত, সেখানে মানুষ স্কিল ডেভেলপ করতে পারত; যে যেই কাজটা করতে চায় সে সেটা জানত। তাদের যদি একটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকত, তাহলে সেটা খুব কাজে লাগত। আমরা তারকা কাকে বলছি সেটাও একটা ব্যাপার। কিন্তু আমি যদি অভিনয়শিল্পীর কথা বলি, তারা ডেফিনেটলি তাদের সততা, পরিশ্রম ও ডেডিকেশনের ওপরই বেশি ফোকাস করবে।
কালবেলা : আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ কী?
বাঁধন : আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ—আমি নিজেকে মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করতে শুরু করেছি। আমি জেনেছি মানুষ হিসেবে আমি এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারি। আমার অধিকারগুলো পাওয়ার অধিকার আমার আছে। আমার স্বাধীনতা পাওয়ার অধিকার আছে, যেটা থেকে আমি বঞ্চিত প্রতিমুহূর্তে প্রতি পদক্ষেপে। আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত হচ্ছে যে মুহূর্তে আমি আমার বাচ্চাকে জন্ম দিয়েছি। ওই মুহূর্ত ছাপিয়ে আমার জীবনে এখনো কোনো মুহূর্ত আসতে পারেনি।
কালবেলা : বর্তমানে ঠিক কোন কোন সিনেমা বা কনটেন্টের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ আছেন?
বাঁধন : এর মধ্যে কোনো সিনেমা বা কনটেন্টের সঙ্গে আমি যুক্ত হইনি। এমন কিছু হলে আমি অবশ্যই জানাব।
মন্তব্য করুন