সম্প্রতি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের কন্যা অর্পিতা শাহরিয়ার মুমুর (৪১) মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। বাথরুমের জানালার সঙ্গে গলায় রশি বাঁধা অবস্থায় লাশটি ঝুলে থাকায় এই মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে ধারণা করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
অন্যদিকে নেটনাগরিকদের অনেকেই মনে করতেন অভিনেত্রী সাফা কবির হচ্ছেন শাহরিয়ার কবিরের মেয়ে। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিনেত্রী সাফার মৃত্যুর গুঞ্জন চাউর হয়। এতে বিব্রত হন অভিনেত্রী ও তার পরিবার। তাই ফেসবুকে একটি পোস্ট ও লাইভ করে নিজের জীবিত থাকার প্রমাণ দেন সাফা কবির। আরও জানান, তিনি শাহরিয়ার কবিরের মেয়ে নন। এমনকি তিনি এবং তার পরিবারের কেউ শাহরিয়ার কবিরকে চেনেনই না।
শাহরিয়ার কবিরকে না চেনার কারণে অভিনেত্রী সাফার ওপর চটেছেন দেশের বরেণ্য সাংস্কৃতিক যোদ্ধা, সুরকার ও সংগীত পরিচালক শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদ। ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, লেখক শাহরিয়ার কবীরকে চেনেন না মডেল সাফা কবীর। এই কথা আবার অনলাইনে এসে বলেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ এবং ভাষা আন্দোলনে শহীদ, বীরাঙ্গনারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে সাফাদের মতন শিল্পীদের জন্য এ দেশ স্বাধীন করেন নাই। ওনাদের মতন এত জ্ঞানী শিল্পীদের অন্য দেশে চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হোক।
শাহরিয়ার কবিরকে না চেনার জন্য সাফাকে অন্য দেশে পাঠিয়ে দিতে চাওয়ার এই ধরনের মানসিকতার বিরোধিতা করেছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা মোটামুটি উত্তপ্ত তাওয়ার ওপর বসে আছি। অনেকেই যেতে আসতে তাওয়ার নিচের আগুনে তুশ ছুঁড়ে দিচ্ছে, কেউবা দিচ্ছে ঘি। সামনের ডিসেম্বর আসতে আসতে এই তাওয়ার অবস্থা কী হয়—এই নিয়ে বড় আতংকে আছি। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষই এরকম একটা উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন। এই উৎকণ্ঠা একমাত্র দূর করতে পারত আমাদের দূরদর্শিতা, আমাদের দিলের রহম আর সহাবস্থানে ইচ্ছুক মন।
এরপর ফারুকী লেখেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা আমাদের সব কমিটিই নির্মূল কমিটি। আমাদের সব আদর্শই অপর আদর্শকে বিনাশ করার মধ্যেই নিজের গৌরব খুঁজে পায়! এখানে যে দল ক্ষমতায় থাকে তারা ক্ষমতার বাইরের দলকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়! এবং এটা পালাক্রমে চলতেই থাকে, মাত্রার তারতম্য থাকে শুধু। এই নিশ্চিহ্ন করার বাসনা ব্যক্তি জীবনেরও এত গভীরে চলে যায়, শাহরিয়ার কবিরকে না চেনার অপরাধে সাফা কবিরকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে মন চায় আমাদের। যেন কিম জং উনকে না চেনার অপরাধে বসা এক কোর্ট মার্শাল। আমাকেও এরকম বহু মব ট্রায়ালে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোন কোন ট্রায়ালে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হইছে।
নির্মাতা আরও লেখেন, ২০১৪ বা ১৫ সালের দিকে একটা লেখায় লিখেছিলাম, এই দেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপি একটা বাস্তবতা। আওয়ামী লীগের পক্ষে বিএনপি সমর্থক কোটি কোটি মানুষকে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়া সম্ভব না। বিএনপির পক্ষেও তা সম্ভব না। এমনকি জামায়াতে ইসলামী প্রায় দশ বছর প্রবল চাপের মুখে থেকেও সেদিন সমাবেশে দেখিয়েছে, আপনি চাইলেই কোনো একটা আদর্শে বিশ্বাসী মানুষদের মুছে দিতে পারেন না। বরং এই চেষ্টায় আখেরে যেটা হয় সেটা হলো আমাদের কালেকটিভ শক্তির ক্ষয়! জাতির প্রাণ শক্তি ক্ষয় হয়।
শেষের দিকে ফারুকী লিখেছেন, আমরা তো অনেক কিছুই ছেড়ে আসছি। উন্মুক্ত স্থানে টয়লেট করা বাদ দিছি। এনালগ ফোনের জায়গায় মোবাইল টেপা শিখেছি। এক সঙ্গে থাকাটা কেনো শিখতে পারব না? কেন এটা বুঝতে চাইব না সবাই আমার মতো একই দল করবে না, একই স্রষ্টায় বিশ্বাসী হবে না, সবাই একই রকম খাবার খাবে না, একইভাবে ভালোবাসবে না? কেনো এটা বুঝতে চাইব না, যার যার স্টেক নিয়ে সমাজের সব পক্ষই পাশাপাশি থাকবে? তর্ক হবে, বিতর্ক হবে, কিন্তু নির্মূলের ব্যর্থ চেষ্টা হবে না। সময় এসেছে সকল নির্মূল কমিটির দোকান বন্ধ করে দেওয়ার।
মন্তব্য করুন