নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল ও অভিভাবকদের নানামুখী হয়রানির প্রতিবাদে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভিকারুননিসার অভিভাবকরা এ মানববন্ধনের আয়োজন করে।
সোমবার (১০ জুন) বেলা সাড়ে ১২টায় এ মানববন্ধন শুরু হয়। এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা এ কর্মসূচিতে অভিভাবকরা নতুন শিক্ষাক্রম কেন যথোপযুক্ত নয় এবং শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ওপর এটি কেমন প্রভাব ফেলছে তার বিষয়ে বর্ণনা দেন।
মানববন্ধনে অভিভাবকরা বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম আসার আগে বলা হয়েছিল, বাচ্চারা সায়েন্স, আর্টস ও কমার্স একসঙ্গে পড়ার সুযোগ পাবে। কিন্তু নবম শ্রেণির বইগুলো ঘেটে দেখা গেছে কমার্সের ‘ক’-ও নেই। বাণিজ্য শিক্ষাকে জিরো করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তাদের কথা মিথ্যা এবং শিক্ষার্থীরা সেটি শিখল। আরও শিখল, নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে যারা রয়েছেন, তারা মিথ্যা কথা বলে। কমার্স ছাড়াও সায়েন্স-আর্টসেরও একই অবস্থা।
তারা বলেন, স্কুল থেকে যে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়, তা গুগল দেখে করে আনতে বলা হয়। গুগল থাকলে স্কুলের কী প্রয়োজন আছে? অভিভাবকদের কষ্টার্জিত টাকা শিক্ষার্থীদের পেছনে ব্যয় করছে, কিন্তু এই টাকা দেশে থাকছে না। কারণ, বেশিরভাগ পণ্যই আমাদের দেশে উৎপাদন হয় না। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে কিনে আনা লাগে। আবার যেসব পাঠ্যবই বাচ্চাদের দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ছিঁড়ে যাচ্ছে। মূলত দেশিয় বিভিন্ন কারখানা ধ্বংস করায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
তারা আরও বলেন, আমাদের ওপর নতুন শিক্ষাক্রম চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে অনেক অভিভাবকই সরাসরি কথা বলতে ভয় পান। কিন্তু প্রশ্ন হলো- আমাদের করের টাকায় সরকার চলে, আমাদের কষ্টার্জিত টাকায় বাচ্চাকে পড়াই, তাহলে আমরা ভয় পাব কেন? সরকার যদি আমাদের ভোটে নির্বাচিত হয়, তাহলে তো সরকারের আমাদের ভয় পাওয়া উচিত।
তাহেরা আক্তার রুপা নামে এক অভিভাবক বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা প্রস্তুত নয়। আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েট করা অভিভাবক। কিন্তু আমিও অনেক কিছু বুঝতে পারছি না। নতুন শিক্ষাক্রম আসার পর আমাদের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। স্কুলের অ্যাসাইনমেন্ট বা প্রজেক্ট হিসেবে ছবিসহ অনেক কিছু প্রিন্ট করে দিতে হচ্ছে। বাচ্চারা পড়া তৈরি করতে গিয়ে ঘুমানোর সময় পাচ্ছে না। এ কেমন শিক্ষাব্যবস্থা।
তিনি বলেন, অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর বৈঠক হলে আমরা তাকে সমস্যাগুলো বুঝিয়ে বলতে পারতাম। মূলত প্রধানমন্ত্রীর অগোচরে অনেক কিছুই হচ্ছে। তিনি হয়ত অনেক কিছুই জানেন না। তাই প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান, আপনি অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলুন এবং সমস্যাগুলোর বিষয়ে নজর দেন।
মর্জিনা খান নামে আরেক অভিভাবক বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের কারণে শিক্ষার্থীরা মৌলিক শিক্ষা থেকে সরে গেছে। রাতে কম ঘুমিয়ে সকাল ৭টায় ক্লাসে যাচ্ছে। মাউশির (মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর) রিসাইকেল পেপারের নির্দেশনার সঙ্গে বাস্তবনা মিলছে না। শিক্ষার্থীদের প্রচুর শিক্ষা উপকরণ কিনে দিতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল চাচ্ছি না। আমরা বলছি, নতুন শিক্ষাক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উপযুক্ত করতে হবে। যুগোপযোগী ও বাস্তবমুখী করতে হবে। বিশেষ করে মূল্যায়ন বিষয়টি এখনও অস্পষ্ট। এ বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে। শিক্ষকের মতো অভিভাবকদেরও শিক্ষাক্রমে সম্পৃক্ত করতে হবে।
আহসানি তাকবিম নামক একজন অভিভাবক বলেন, বাচ্চার ডিভাইস ব্যবহার করার কারণে আমাদের দাম্পত্যকলহ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমের কারণে ৬ষ্ঠ শ্রেণির একজন বাচ্চাকে যখন স্মার্টফোন ব্যবহার করার অনুমতি দিতে হয়, তখন সে যদি লাভ, রিলেশনশিপে জড়ায়- এর দায় কে নিবে? এসব বিষয় শিক্ষামন্ত্রীর মাথায় রাখতে হবে।
হামিদা পারভীন নামক আরেক অভিভাবক বলেন, ১২-১৩ বছরের কোমলমতি শিশুদের হাতে মোবাইল তুলে দেওয়া হলে তারা নিশ্চয়ই পরীমনি বা শাহরুখ খানের নাচ না দেখে থাকবে না। স্কুলগুলো কি সিনেমা হলে রুপান্তরিত হবে কিনা সেটাই ভাবছি। এজন্য অনতিবিলম্বে এই শিক্ষাক্রম বাতিল করতে হবে।
তিনি বলেন, এই শিক্ষাক্রমের ফলে উচ্চশিক্ষার প্রতিযোগিতায় আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে থাকবে। এসব কারণে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত বেশিরভাগই এটি মেনে নিতে পারছেন না। কিন্তু তারা কিছু বলতে পারছেন না। অভিভাবকদেরও সমালোচনা করার সুযোগ নেই। কারণ, এরই মধ্যে সমালোচনা করায় অভিভাবকদের নামে মামলা দিয়ে এক ধরণের ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। আমরা নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল চাই এবং মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার চাই।
আল আসমাউল হুসনা নামক একজন অভিভাবক বলেন, যেহেতু পরীক্ষা নেই, অনেকেই পড়াশোনা একপ্রকার ছেড়ে দিয়েছে। বাচ্চারা পাঠ্যবই পড়বে, এটাই নিয়ম। কিন্তু বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট, প্রজেক্টের নামে তাদের বইয়ের চেয়ে বেশি ডিভাইসে আসক্ত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম আসার আগে শিক্ষিত মায়েরা বাচ্চাদের পড়াতে পারতাম, যা এখন পারছি না। শিক্ষকরাই তো কিছু বুঝে না। সে কারণে তারা শিক্ষার্থীদের গুগল বা ইউটিউব দেখে পড়া কপি করতে বলে। কেউই কিছু বুঝে না, একমাত্র গুগল বুঝে। কোচিং-প্রাইভেট কমবে বলা হলেও এটি উল্টো বেড়েছে। আমরাও বাধ্য হচ্ছি। এজন্য শিক্ষামন্ত্রীর কাছে বলতে চাই, আপনি আমাদের সঙ্গে বসুন। আমাদের কথা শুনুন।
মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত বলেন, অনলাইনে কোনো সংবাদ দেখতে বা কোনো কাজ করতে গেলে সেখানে যেসব বিজ্ঞাপন সামনে আসে, সেখানে অশ্লীল বিজ্ঞাপনও আসে। চাইলেও প্রতিরোধ করা যাবে না। কাজেই শিক্ষার্থীকে যখন ডিভাইসমুখী করা হচ্ছে, তখন তাকে এসব অশ্লীল বিষয়গুলোর দিকে ধাবিত করা হচ্ছে। আবার গেমসের মতো আসক্তির মধ্যে নিমজ্জিত করে ফেলার প্রচেষ্টা নতুন শিক্ষাক্রমের মধ্যে হচ্ছে। শিক্ষাক্রম যখন শতভাগ পরিবর্তন করা হচ্ছে, তখন দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদের মতামতও কিন্তু নেওয়া হয়নি।
মানববন্ধনে আরও বক্তব্য রাখেন ভিকারুননিসার অভিভাবক রীতা আজাদ শান্তি ও খালেদা আক্তার। এতে সংহতি জানিয়ে নবকুমার স্কুলের অভিভাবক মুসলিম বিন হাই ও মিরপুর বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক জাকারিয়া রাজিব বক্তব্য রাখেন।
মন্তব্য করুন