আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন, পদোন্নতি, অধ্যাপক পদ ৩য় গ্রেডে উন্নীতকরণ, অর্জিত ছুটি প্রদান এবং আনুপাতিক হারে ১ম ও ২য় গ্রেডসহ প্রয়োজনীয় পদসৃজন, চাকরির ৫ বছর পূর্তিতে ৬ষ্ঠ গ্রেড প্রদানসহ বিভিন্ন দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা। দাবি আদায়ে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সর্বশেষ কমিটি বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলেও সেটি আলোর মুখ দেখেনি। যে কারণে শিক্ষা প্রশাসনের আসন্ন হাইভোল্টেজ নির্বাচনে ক্যাডার বৈষম্য নিরসনসহ অন্য বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে।
ভোটাররাও বলছেন, ক্যাডার বৈষম্য নিরসন, পদোন্নতি ও নতুন পদ সৃষ্টির মতো গুরুত্ব বিষয়গুলোকে যারা বেশি গুরুত্ব দিবেন, তাদেরই নেতা হিসেবে বেছে নিবেন তারা।
জানা গেছে, শিক্ষা ক্যাডারদের সংগঠন বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন হবে আগামী রোববার (৯ জুন)। সারা দেশে ২১৪ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ করা হবে। মোট ভোটার ১৩ হাজার ৫৯৬ জন। সারা দেশের ১১টি সাংগঠনিক শিক্ষা বিভাগে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাসহ সরকারি কলেজ শিক্ষক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), শিক্ষাবোর্ড, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ (টিটি কলেজ), জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে কর্মরত ক্যাডার কর্মকর্তারা এ নির্বাচনে ভোট দিবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে তিনটি প্যানেল ও দুইজন স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশগ্রহণ করছে। এর মধ্যে ‘ক’ নামক প্যানেলের নেতৃত্বে রয়েছে রুহুল কাদির-হুমায়রা-কামাল। ‘খ’ নামক প্যানেলের নেতৃত্বে রয়েছেন মামুন-জিয়া-নাসির। ‘মূলধারা ঐক্য প্যানেল’ নামে পরিচিত এই প্যানেল। ‘গ’ নামক প্যানেলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন শাহেদ-তানভীর-মোস্তাফিজ।
শুরু থেকেই গ প্যানেলের শীর্ষ পদের প্রার্থীরা অন্যদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। তবে নির্বাচনের তিন দিন আগে গত বুধবার এই প্যানেলের সভাপতি প্রার্থী মাউশির কলেজ ও প্রশাসন শাখার পরিচালক অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরীকে সরকারি বিজ্ঞান কলেজের অধ্যক্ষ পদে বদলি করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষাভবন হিসেবে পরিচিত মাউশির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদের ব্যক্তিকে বদলি করায় নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক প্যানেল থেকে গত নির্বাচনেও অধিকসংখ্যক প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিল। তাদের নেতৃত্বে ছিল সর্বশেষ কমিটির সাধারণ সম্পাদক শওকত হোসাইন মোল্লা। তবে এবার তিনি প্যানেলের সঙ্গে নেই। স্বতন্ত্র হিসেবে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হয়েছেন। এছাড়াও নিজেদের মধ্যে বিভক্তির কারণে এবার এই প্যানেলের অবস্থা বেশ নাজুক। শিক্ষা প্রশাসনের দপ্তরগুলোতে গিয়ে প্রচারণার চেয়ে ফেসবুকে প্রচারণায় তারা বেশি সক্রিয়। এছাড়া গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ৯৫টি পদ থাকলেও তারা প্রার্থী দিয়েছেন ৪৯টি পদে। আবার অভিযোগ রয়েছে- এই প্যানেলের অনেকেই আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এসব কারণে আঞ্চলিক কিছু পদে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সর্বোচ্চ পদগুলোতে সম্ভাবনা কম- এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ক প্যানেলের সভাপতি প্রার্থী ড. আজম রুহুল কাদীর চাঁপাইনবাবগঞ্জের নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। জানতে চাইলে তিনি কালবেলাকে বলেন, আমরা যেসব জায়গায় যাচ্ছি সেখানেই প্রচুর সাড়া পাচ্ছি। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট প্যানেল চাপ প্রয়োগ করে প্রচারণায় বাধা দিচ্ছে। মূলত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ভয়-ভীতি দেখানোর কারণে পূর্ণ প্যানেল দিতে পারিনি। প্যানেলের প্রার্থীদের ভিন্ন রাজনীতির বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মত তার।
তিনি বলেন, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এটি অব্যাহত থাকবে। কিন্তু যাদের চেয়ারের মায়া আছে, তারা এটি করবে না।
এই প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী হুমায়রা আক্তারের বাড়ি গোপালগঞ্জে। ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রী হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। তবে ক প্যানেলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় তার ভোটব্যাংক কমতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে হুমায়রা আক্তার কালবেলাকে বলেন, আগের কমিটির নেতারা ক্যাডার সার্ভিসের সমস্যাগুলোর সমাধান করেন নি। সে কারণে ক্ষোভ থেকে নিজেই প্রার্থী হয়েছি। প্যানেলের বাকিরাও বঞ্চনা ও ক্ষোভ থেকে প্রার্থী হয়েছে। আমরা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। বাকি বিবেচনা ভোটারদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খ প্যানেলের কয়েকজন প্রার্থী বিগত সময়ে বিএনপির প্যানেল বলে পরিচিত প্যানেল থেকে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু এগুলোকে অপপ্রচার বলছেন প্যানেলের নেতারা। এই প্যানেলের সভাপতি প্রার্থী অধ্যাপক মামুন উল হক কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এক সময় নায়েমে চাকরি করার সুবাদে পরিচিতিও রয়েছে বেশ। তাছাড়া তিনি সর্বশেষ কমিটির সহসভাপতিও ছিলেন। এসব কারণে গ প্যানেলের সভাপতি প্রার্থী শাহেদুল খবির চৌধুরীর সঙ্গে তার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে পারে।
এছাড়া, সাধারণ সম্পাদক পদে জিয়া আরেফিন আজাদও পরিচিতির কারণে মাঠ কাঁপাবেন। তবে এই প্যানেল ৯৫টি পদের মধ্যে নির্বাহী সদস্যের কয়েকটি পদে প্রার্থী দিতে পারেনি। এই প্যানেল থেকে আঞ্চলিক অনেক পদে জয়লাভ করার সম্ভাবনা রয়েছে।
জানতে চাইলে অধ্যাপক মামুন উল হক কালবেলাকে বলেন, প্রচারণার সময় অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছি। ভোটারদের ওপর আস্থা রাখতে চাই।
তিনি বলেন, সাবেক দুইজন শিক্ষামন্ত্রী এই ক্যাডার সার্ভিসকে শিক্ষা ভবন ও বাহির- এই দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছিলেন। সে কারণে শিক্ষাভবন কেন্দ্রিক ক্ষমতা চলে যাওয়ায় বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এর প্রতিকার চাই। প্যানেলের প্রার্থীর ভিন্ন রাজনীতির বিষয়ে তিনি বলেন, আমার প্যানেলে স্বাধীনতার পক্ষের ও দুর্নীতিগ্রস্থ নয় এমন ব্যক্তিদের স্থান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে, তারা ক্যাডার সার্ভিসের রুলস মানছেন না। আমাদের নয় বরং বাকি প্যানেলগুলোতে এমন প্রার্থী পাওয়া যাবে।
গ প্যানেলই একমাত্র পূর্ণ প্যানেলে প্রার্থী দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এবার এই প্যানেল থেকে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী বিজয়ী হবেন। প্যানেলের সভাপতি পদপ্রার্থী অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী অ্যাসোসিয়েশনের সর্বশেষ কমিটির সভাপতি। এছাড়া মাউশির পরিচালক হওয়ায় তার পরিচিতিও বেশ। তাই তিনি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।
জানতে চাইলে তিনি কালবেলাকে বলেন, বেশ কয়েকজন তরুণকে প্যানেলে রেখেছি। আশা করছি তারুণ্যের সহযোগিতা পাব। আমরা পূর্ণ প্যানেলে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। তিনি বলেন, আমাদের প্যানেলে যারা আছেন, তারা প্রগতিশীল রাজনীতির সমর্থক। আমাদের সরকারের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ রয়েছে, অন্য প্যানেলগুলোর সেটি নেই। আশা করি ভোটাররা এসব বিষয় বিবেচনা করবেন।
এই প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী মাউশির সহকারী পরিচালক তানভীর হাসান। তরুণ বেশিরভাগ সদস্যের ভোট তানভীর হাসানের পক্ষে। যদিও সমালোচকরা বলছেন, ক্যাডার সার্ভিসে অনেক জুনিয়র হওয়ায় অনেক কাজই তিনি ঠিকমতো করতে পারবেন না। তবে এসব সমালোচনা জয়ের পথে বাধা হবে না বলে বিশ্বাস তানভীর হাসানের।
তিনি কালবেলাকে বলেন, ১৪ থেকে ৪২তম ব্যাচের ক্যাডাররা যোগ্যতায় কেউ কারও থেকে কম নয়। গত ১৫ বছর ধরে চাকরি করছি। বিশেষ করে ৪ বছর ধরে আমি মাউশির কলেজ শাখায় কর্মরত রয়েছে। আমি মনে করি কলেজের ক্যাডার সার্ভিসের যেসব সমস্যা রয়েছে এবং সেগুলোর সমাধান কীভাবে সম্ভব- এটি আমার পদে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাদের চেয়ে বেশি ভালো জানি। তাছাড়া এটি একটি টিমওয়ার্ক। সবার সহযোগিতায় ক্যাডার সার্ভিসের সমস্যাগুলো দূর করা সম্ভব হবে।
এই প্যানেলের কোষাধ্যক্ষ পদে নির্বাচন করছেন এনসিটিবির উপসচিব (কমন) সৈয়দ মোস্তাফিজুর রহমান লিখন। চব্বিশ ব্যাচের দুইবারের নির্বাচিত সভাপতি হওয়ায় তিনিও বেশ জনপ্রিয়। অঘটন না ঘটলে তিনিই অর্থ সম্পাদক হবেন-বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে শওকত হোসেন মোল্লা বেশ শক্তিশালী প্রার্থী। গতবারের মতো এবার তারুণ্য তার পাশে না থাকলেও নিজ ব্যাচ ও জ্যেষ্ঠদের ভোট পাবেন। এ নির্বাচনে তানভীর হাসানের সাথে তাকেই প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছেন অনেকেই। শওকত হোসেন মোল্লা কালবেলাকে বলেন, নো বিসিএস, নো ক্যাডার আন্দোলনের কারণে শিক্ষা ক্যাডারদের মধ্যে আমার জনপ্রিয়তা রয়েছে। তাই জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। তিনি বলেন, শিক্ষা ক্যাডারদের মধ্যে এটা স্পষ্ট হয়েছে, অফিসের কর্মকর্তাদের দিয়ে সমিতি চালানো কষ্টকর। সে কারণে আশা করছি এবারও বিগত নির্বাচনের মতো সবাই আমাকে বেছে নিবে।
মন্তব্য করুন