অবৈধভাবে সংযোগ নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের টিএসসি সংলগ্ন ৩নং ফটকের দোকানগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে প্রতি মাসে প্রায় এক লাখ টাকা চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে।
চাঁদা বাণিজ্যে অভিযুক্তরা হলেন- মফিজ, সাদ আলী উরফে চাঁদ ও রিয়াদ। তারা তিনজন উন্মুক্ত লাইব্রেরির কোণে অবস্থিত টিনের ঘরে থাকেন এবং এখান থেকেই এই চাঁদাবাজির কার্যক্রম পরিচালনা করেন ।
সরেজমিনে দেখা যায়, উদ্যানের ভিতরে অন্তত দেড়শ দোকান গড়ে উঠেছে। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বিভিন্ন পানীয় এবং খাবারের দোকান রয়েছে সেখানে। টিএসসি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় ঘুরতে আসা নারীদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী বিক্রির দোকানও।
দোকানে ওই তিন কেয়ারটেকারের পাশাপাশি শাহজাহান ও ইয়াসিন নামে আরও দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে কয়েকটি দোকানে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে চাঁদা তোলার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের টিএসসি সংলগ্ন ৩নং ফটকে 'স্বাধীনতা যাদুঘর' লেখা পিলারে স্থাপিত বৈদ্যুতিক বাতির তার থেকে সংযোগ নিয়ে এই এলাকার সকল দোকানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরকার সকল ভ্রাম্যমাণ দোকান উচ্ছেদ করে দেওয়ার পর সেই দোকানগুলো এখানে বসতে থাকে। তখন থেকেই অভিযুক্তরা এ কাজ করে আসছেন। এছাড়া, ফটকের পাশের ফুটপাতে অবস্থিত বিদ্যুৎ সংযোগের একটি বাক্স থেকে অবৈধভাবে দুটি লাল তারের মাধ্যমে উন্মুক্ত লাইব্রেরিতেও বিদ্যুতের সংযোগ ঘটানো হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উদ্যানের এই গেটে প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় দেড়শ দোকান বসে। এর মধ্যে প্রায় ৬৫টি দোকানে বাতি জ্বালাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এসব দোকানে পরিধিভেদে ১ থেকে ৫টি পর্যন্ত বাতি ব্যবহার করা হয়। প্রতি বাতি বাবদ বিল নেওয়া হয় দৈনিক ৩০ টাকা এবং দুই বাতির বিল একসঙ্গে ৫০টা টাকা। প্রতি দোকানে গড়ে দুটি করে বাতি ধরা হলে প্রতিদিন এর বিলের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ২৫০ টাকা, যা একমাসে পরিমাণ হয় ৯৭ হাজার টাকা। যদিও বাস্তবিক অর্থে এর পরিমাণ আরও বেশি।
এর বাইরে উদ্যানের প্রবেশ মুখে অভিযুক্ত শাহজাহানের একটি বিশাল পানির পাইকারি দোকান রয়েছে, সেখানে কয়েকদিন আগ পর্যন্ত দুটি রেফ্রিজারেটরও ব্যবহার করা হতো বলে জানা গেছে। তা ছাড়াও, এখানে তার আরও চারটি দোকান (চটপটির ২টি, আইস্ক্রিমের ১টি ও চায়ের দোকান ১টি) রয়েছে। এ দোকানগুলোতে ৩-৫টি করে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো হয়। যার সবই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিদ্যুৎ লাইন থেকে অবৈধ সংযোগ নেওয়া বলে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন।
এ বিষয়ে তার ভাষ্য, আমি কোন ফ্রিজ-ট্রিজ চালাই না। আর দোকানগুলোর বাতির তার পার্কের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাইন থেকে নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ বিল কোথায় এবং কাকে দেওয়া হয় জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
উদ্যানের একাধিক দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া দোকানসমূহ থেকে মফিজ, সাদ আলী উরফে চাঁদ ও রিয়াদ চাঁদা তোলেন। সরেজমিনে দেখা যায়, সংযোগ দেওয়া প্রতিটি দোকান থেকেই বাতি জ্বালানোর বিল হিসেবে চাঁদা তুলছেন রিয়াদ। চাঁদা তোলা শেষ হলে উন্মুক্ত লাইব্রেরি সংলগ্ন তাদের থাকার ঘরের সামনে গিয়ে সাদ আলীর হাতে টাকা তুলে দিচ্ছেন তিনি। এ সংক্রান্ত কয়েকটি অডিও, ভিডিও ও ছবি কালবেলার হাতে রয়েছে।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে উদ্যানের প্রবেশ গেটের একাধিক দোকানি কালবেলাকে বলেন, নতুন কেউ দোকান বসালেই তার সঙ্গে সাদ আলী নিজেই বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য যোগাযোগ করেন।
অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার করে অভিযুক্ত সাদ আলী কালবেলাকে বলেন, উদ্যানের লাইন থেকে সংযোগ নিয়ে আমরা কিছু দোকান চালাই। এখানকার দোকানগুলোও আসলে দুই নাম্বার, আমাদের লাইনও দুই নাম্বার। এভাবেই সংসার চালাই।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চাঁদার টাকা লাইনম্যান খোকাকে দিতে হয়। তার দাবি খোকাই এসব দোকান নিয়ন্ত্রণ করে।
অভিযুক্ত খোকা কালবেলাকে বলেন, আমি এসব কিছুতে নেই। এগুলো সব মিথ্যা অভিযোগ। যদিও কালবেলার হাতে খোকার দোকান প্রতি ১৫০ টাকা চাঁদা তোলার প্রমাণ রয়েছে।
অবৈধ বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রসঙ্গে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) সাব এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. লোকমান হোসেন বলেন, এরকম ভোক্তা পর্যায়ের কিছু আমরা দেখিনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশন এই দিকটা দেখে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশলী অফিসের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ কে এম আবু মুছা চৌধুরী বলেন, এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। এছাড়াও বিষয়টি আমাদের আওতাধীন নয়।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কেয়ারটেকার মো. খোকন বলেন, এই লাইনটা মূলত ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের নিয়ন্ত্রণে এটা নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ফুটপাতের যে বাক্স থেকে সংযোগ নেওয়া হয়েছে সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন নয়। এটা ডিপিডিসির আওতাধীন।
সার্বিক বিষয়ে বক্তব্য জানতে শাহবাগ থানার ওসি মোস্তাজিরুর রহমানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও পাওয়া যায়নি।
মন্তব্য করুন