হঠাৎ করেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ভবনে সাংবাদিকদের প্রবেশে ‘অলিখিত’ কড়াকড়ি আরোপ করেছে কমিশন কর্তৃপক্ষ। ইউজিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সাংবাদিকরা যার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাবেন, কমিশন ভবনে প্রবেশের আগে তার আগাম অনুমতি নিতে হবে। আবার অনুমতি মিললেও সেই কর্মকর্তার কক্ষে যাওয়া যাবে না। কর্তৃপক্ষ একটা খোলা জায়গা নির্ধারণ করে দেবেন, সেখানে বসে কথা বলতে হবে।
সম্প্রতি সময়ে ইউজিসি কর্মকর্তাদের অনিয়ম বিষয়ে গণমাধ্যমে বেশকিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সাংবাদিকদের তথ্য পাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতেই এই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
জানা গেছে, সাত কলেজ নিয়ে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ চূড়ান্তে গতকাল রোববার ইউজিসিতে কমিশনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সংবাদ সংগ্রহের জন্য ভবনে প্রবেশ করতে চাইলে কয়েকজন সাংবাদিককে বাধা দেন নিরাপত্তা প্রহরীরা।
তারা জানান, রেজিস্ট্রি খাতায় নাম-পরিচয় লিখতে হবে এবং কোন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলবেন, তা জানাতে হবে। সাংবাদিকরা তখন নিরাপত্তা প্রহরীদের জানান, একজন নয়, সংবাদের প্রয়োজনে একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ করা দরকার। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় জানিয়ে তারা বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন।
একপর্যায়ে তারা ইউজিসির প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সৈয়দ আশ্রাফুজ্জামানকে ডাকেন। তিনি সাংবাদিকদের তার কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে আশ্রাফুজ্জামান জানান নতুন নিয়মের কথা।
তার ভাষ্যমতে, নতুন নিয়মে একজন সাংবাদিককে প্রথমে রেজিস্ট্রি খাতায় নাম-পরিচয়, মোবাইল নম্বর, প্রবেশের সময়, কতক্ষণ থাকবেন এবং কার সঙ্গে দেখা করবেন, তা লিখতে হবে। এরপর সেই কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলবেন নিরাপত্তা কর্মকর্তারা। তিনি সম্মতি দিলে ভবনে প্রবেশের অনুমতি মিলবে। তবে সংবাদকর্মী ওই কর্মকর্তার কক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন না। তিনি কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত একটি ওপেন স্পেসে (খোলা জায়গা) বসবেন। সেখানে কর্মকর্তা এসে দেখা করবেন। অবশ্য সেই জায়গাটি সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় থাকবে কি না তা তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি।
সম্প্রতি ইউজিসি কর্তৃপক্ষ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন সৈয়দ আশ্রাফুজ্জামান। তবে তার কাছে কোনো লিখিত আদেশ নেই। মৌখিকভাবে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান ও সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলাম এ আদেশ দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন তিনি।
ইউজিসিতে প্রবেশের সময় বাধাপ্রাপ্ত দৈনিক জনকণ্ঠের সাংবাদিক আসিফ হাসান কাজল বলেন, ইউজিসিতে শিক্ষা সাংবাদিকদের সবসময় অবাধে যাতায়াতের সুযোগ ছিল। সম্প্রতি তারা সেখানে সাংবাদিকদের প্রবেশ অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করেছেন। আমি নিজে বাধার মুখে পড়েছি। তাদের এ সিদ্ধান্ত উদ্ভট মনে হয়েছে। এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অন্তরায়।
এ বিষয়ে জানতে আজ সোমবার সৈয়দ আশ্রাফুজ্জামানের মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি কোনো কিছু বলতে রাজি হননি। ঘটনাটি সত্য নয় জানিয়ে তিনি ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ জানান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউজিসির কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি ইউজিসি কর্মকর্তাদের অনিয়ম, গণঅভ্যুত্থানে কমিশনের কিছু কর্মকর্তার ভূমিকাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ হন কমিশনের ঊর্ধ্বতনরা। সিসিটিভি দেখে তারা নিশ্চিত হন, কোনো কোনো সাংবাদিক কর্মকর্তাদের কক্ষে কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করছে। এটিও তারা ভালোভাবে নেননি। যে কারণে সম্প্রতি এক সভায় সাংবাদিকদের তথ্য পাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে ইউজিসিতে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন কর্তৃপক্ষ। সে অনুযায়ী অফিস আদেশ জারির বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
তবে ইউজিসি সচিব ফখরুল ইসলাম এমন আদেশ দেওয়া হয়নি বলে দাবি করেছেন। অবশ্য আদেশের কথা স্বীকার করেছেন ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান।
জানতে চাইলে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান রোববার বিকেলে বলেন, নির্দেশনাটা আমি দিয়েছি, এটা সত্য নয়। তবে ইউজিসির প্রশাসনিক সভায় সাংবাদিকসহ সব ধরনের দর্শনার্থীদের প্রবেশের ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
হঠাৎ এমন কড়াকড়ি আরোপের কারণ জানতে চাইলে অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন বলেন, অনেক কর্মকর্তার কক্ষে এক নয়, একাধিক ব্যক্তি এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করেন। এতে কাজের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। আবার কিছু কাগজও মিসিং (খোয়া গেছে)। সে কারণে এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এখনও অর্ডারটি (অফিস আদেশ) হয়নি। দু-একদিনের মধ্যে এ নিয়ে আদেশ হতে পারে।
তবে বিষয়টি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে বলে দাবি করেছেন ইউজিসি সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলাম। তিনি কালবেলাকে বলেন, এমন কোনো আদেশ জারি হয়নি। সাংবাদিকদের আমরা প্রবেশে বাধা দেব কেন? সভায় কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে তাও বেশ কয়েকদিন আগে। কিন্তু সেই সভার কিছু সূত্র ব্যবহার করে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়েছে। ইউজিসির কিছু অতি উৎসাহী কর্মকর্তা এটি ছড়িয়েছেন।
এদিকে সাংবাদিক প্রবেশে এমন কড়াকড়ি আরোপ করায় ক্ষোভ জানিয়েছেন শিক্ষা বিটে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন এডুকেশন রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশের (ইরাব) সভাপতি ফারুক হোসাইন। তিনি কালবেলাকে বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারও ইউজিসিতে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপের দুঃসাহস দেখায়নি। কিন্তু পটপরিবর্তনের পরে কমিশনের এ ধরনের চিন্তাভাবনা আমাদের অবাক করেছে।
তিনি বলেন, আমরা শুনেছি এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে ইউজিসি। যদিও এখনো কোনো অফিস আদেশ জারি হয়নি। তবে, তারা যদি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, ইরাব মূলধারার সাংবাদিক সংগঠনগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে নামবে।
মন্তব্য করুন