চারুকলার সঙ্গে জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা জানতে একটি গবেষণা প্রকল্প হাতে নিয়েছে শিল্প, প্রকৃতি ও স্বাস্থ্য গবেষণা কেন্দ্র এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। এ লক্ষ্যে মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) চারুকলা অনুষদের ওসমান জামাল মিলনায়তনে এই গবেষণা কর্মশালা শুরু হয়।
প্রকল্প অনুযায়ী, অনুষদের ৩৩৫ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করবে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গবেষক ও ডাক্তারদের একটি দল। দীর্ঘ এক বছর ধরে চলবে এই গবেষণা কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থীদের নিয়ে এই প্রথম এ ধরনের গবেষণা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়।
দু’দিনব্যাপী ‘চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের চোখ এবং মানসিক স্বাস্থ্য’ শীর্ষক এই গবেষণা কর্মশালার প্রথমদিন ৩টি স্টেশন অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধনী সেশনের সভাপতিত্ব করেন শিল্প, প্রকৃতি ও স্বাস্থ্য গবেষণা কেন্দ্রের কিউরেটর এবং শিল্পকলা ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান ড. শেখ মনির উদ্দিন।
ড. মনির বলেন, আমরা যারা শিল্পকলার সঙ্গে কাজ করি আমাদের শারীরিক ও মানসিক চোখ রয়েছে। শারীরিক চোখ দিয়ে দেখে আমরা অনেক কিছু চিন্তা করি। আমার শিক্ষকতা জীবনে আমার শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যা দেখেছি। অল্প বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া চারুকলা অঙ্গনে একটু বেশি। এভাবে অনেকেই চলে গেছেন। কিন্তু কি এমন কারণ রয়েছে, এটা নিয়ে আমি কাজ করছি। শিল্পীদের শারীরিক ও মানসিক দিক নিয়ে যদি আমরা কাজ করি তাহলে আমাদের চারুকলাসহ অন্যান্য দিকের জন্যও ভালো হবে।
বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ক্রাফট বিভাগের অধ্যাপক ফারুক আহমেদ মোল্লা, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মাহবুবুর রহমান, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আবুল হাসান মো. শামীম।
কর্মশালার উদ্বোধক ও প্রধান অতিথি অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার বলেন, শিল্পীরা একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষ। আমি এখানে যে বিভাগে ভর্তি হতে চেয়েছিলাম সেটি বন্ধ ছিলো। সঙ্গত কারণে কর্তৃপক্ষ আমাকে ভর্তি নিতে রাজি হননি। কিন্তু আমার প্রবল ইচ্ছার কারণে শেষ পর্যন্ত আমাকে ভর্তি নেওয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন, অনেক সময় কাজ করতে করতে মানসিক চাপে মনে হতো আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। কাজ করতাম আবার কিছু সময় ঘুরা ঘুরি করতাম। শিক্ষার্থীরা যখন কাজ করেন তখন একের সাথে অন্যের তুলনা করেন। এগুলো শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার বলেন, শুধু শিক্ষার্থী না, যারা শিল্পী তারাও অনেক কিছু মানেন না। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমরা বই পড়তে আগ্রহী না। আমরা মনে করি পড়লে তার শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে, ছবি আঁকতে পারবে না। আমি যখন পিএইচডি করার সিদ্ধান্ত নিলাম তখন আমাদের কোন শিক্ষকই আমাকে সমর্থন করেন নাই। তাদের ধারনা, লেখাপড়ার মধ্যে মন ঢুকালে আমি আর ছবি আঁকতে পারব না।
চিত্রশিল্পীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমরা অনেক কিছুই জানি না। সিগারেটের গায়ে লেখা আছে খাওয়া যাবে না এরপরও আমরা খাচ্ছি এবং এইটা আমাদের শিল্পীদের মধ্যে বেশি। আমরা বুঝি কোনটা ক্ষতিকারক কিন্তু আমরা এগুলো পালন করি না এইটা আমাদের শিল্পীদের সবচেয়ে বড় দোষ।
তিনি বলেন, যারা মন খুলে হাসে তারা অনেক বেশি সুস্থ থাকে। পড়তে হবে। না পড়লে আমরা কিছুই বুঝবো না। আমরা ছোট থেকে সেট করে ফেলেছি শিল্পী হলে লেখাপড়া করা যাবে না; এইটা খুব খারাপ।
উদ্বোধনী সেশনের পরে শুরু হয় বৈজ্ঞানিক সেশন। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, চোখ আর মন আমাদের জীবনকে রঙিন করে। চোখ আমরা বাহ্যিকভাবে দেখি কিন্তু মন হচ্ছে ব্রেন। চিন্তা, আবেগ ও আচরণ আমাদের ব্রেনের কার্যক্রম। চিন্তা থেকে আবেগ আসে এবং আবেগ থেকে আমাদের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়। আমরা সব চিন্তাকে আবেগে রুপান্তরিত করি না। যুক্তি আর বিচার করা ছাড়া আমরা কাজ করি না।
তিনি বলেন, যারা আঁকাআঁকির কাজ করে এগুলো তাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারো মন বুঝতে চাইলে আমরা তার চোখ ও মুখের দিকে তাকাই। আমাদের মনের যত্ন নিতে হবে। বাংলাদেশের শতকরা ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ মানসিক সমস্যায় ভুগতেছে। এজন্য আমাদের ভালো থাকতে মনের যত্ন নিতে হবে।
বৈজ্ঞানিক সেশনের শুরুতে ‘চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের চোখ এবং মানসিক স্বাস্থ্য’ শীর্ষক গবেষণা প্রপোজাল উপস্থাপন করেন ডা. একরামুল হক। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞ প্যানেল হিসেবে বক্তব্য রাখেন ডা. মো. শফিকুল আলম, ডা. সাজ্জাদ হোসেন, ডা. মো. শাহাদাত হোসেন ও ডা. জাহরা মুস্তাফিজ অন্তরা।
সেশন সমন্বয়ক হিসেবে ছিলেন ডা. নাইম হাসান। সেশন পরিচালনা করেন ডা. মোস্তফা আহমেদ। দূত হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডা. রাহনুমা রায়হান সূচি।
এই সেশনের পরে বিকেল সাড়ে ৫টায় ‘শিল্প, প্রকৃতি এবং স্বাস্থ্য : আন্তসম্পর্ক ও প্রভাব’ শিরোনামে শুরু হয় কর্মশালার তৃতীয় সেশন। এতে সভাপতিত্ব করেন কারুশিল্প বিভাগের অধ্যাপক ফারুক আহমেদ মোল্লা। কি-নোট স্পিকার হিসেবে গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক শেখ মনির উদ্দিন। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞ প্যানেল হিসেবে বক্তব্য রাখেন ছিলেন অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক ইসরাফিল পি কে, সহকারী অধ্যাপক সঞ্জয় চক্রবর্তী ও শিল্পী মামুন। সেশন পরিচালনা করেন অধ্যাপক ফেরদৌস খান।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ফারুক আহমেদ বলেন, এই ধরনের প্রোগ্রাম আমাদের খুব দরকার। বিশেষ করে চারুশিল্পীদের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যবিত্ত দেশে দৃষ্টি ও মানসিকতাকে আমরা গুরুত্ব দেই না এবং এগুলো আমাদের কি ক্ষতি করে সেটাও আমরা জানি না। শিল্প পর্যায়ে আমাদের মানসিক ও শারীরিক অবস্থার কেমন সম্পর্ক থাকা উচিত তা এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে আমরা জানতে পারবো।
তিনি বলেন, শিল্প চর্চার মধ্যে আমাদের যে উৎসাহ দরকার সেগুলো আমাদের দিন দিন কমে যাচ্ছে। ঘুমন্ত জিনিসকে কিভাবে জাগ্রত করা যায় সেধরনের প্রোগ্রাম হাতে নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
আগামীকাল বুধবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) অনুষ্ঠিত হবে শিক্ষার্থীদের চোখ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রাথমিক পরীক্ষা কার্যক্রম। এদিন সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলবে এই কার্যক্রম। পাশাপাশি দুপুর ১২টায় অনুষ্ঠিত হবে শিল্প এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক পারফরম্যান্স আর্ট।
মন্তব্য করুন