এক যুগ ধরে বাংলাদেশের প্রায় সব আন্দোলন সংগ্রামে মীর লোকমান সক্রিয় এবং পরিচিত মুখ। অন্যায়-অবিচার কিংবা বৈষম্যের বিপরীতে মূকাভিনয়কে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবেই দেখেন তিনি। তাই তিনি অনেকের কাছে রাজপথের শিল্পী হিসেবেই পরিচিত। তিনি তারুণ্যদীপ্ত মূকাভিনয় সংগঠন ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশন (ডুমা) এবং ইনস্টিটিউট অব মাইম অ্যান্ড মুভমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা।
মীর লোকমান নরসিংদীর শিবপুর উপজেলায় ১৯৯০ সালের ১২ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই বেড়ে উঠেন। মোহর পাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং পাঁচকান্দি ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরবর্তীতে দক্ষিণ কোরিয়ার আজু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুবাদে তিনি বৈচিত্র্যময় জ্ঞান ও পরিবেশের সাথে পরিচিত হন। আর্মেনিয়া, মরক্কো, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন মঞ্চ এবং স্ট্রিটে আটশর মতো প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন তিনি। বহু আন্তর্জাতিক শিল্প উৎসব এবং বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাথে কাজের অভিজ্ঞতা ও চিন্তার বিনিময় তাকে সমৃদ্ধ করেছে।
তিনি আবহমান বাংলার প্রচলিত শিল্প ধারার সাথে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মূকাভিনয় এবং শিল্পের নানা ঢংয়ের সংমিশ্রণে নতুন রীতি নির্মাণে বিশ্বাসী। প্রযোজনার প্রয়োজনে বহুমাত্রিক সেট, প্রপস ও মেকাপের সংযোজনে তার উপস্থাপনা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। টেকনোলজির প্রয়োজনীয় ব্যবহার তার সৃষ্টিকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে তোলে সহজে। সম্প্রতি কালবেলার সঙ্গে তার মূকাভিনয় যাত্রা এবং সামগ্রিক কার্যক্রমের বিষয়ে কথা বলেছেন। মীর লোকমানের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কালবেলার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মো. জাফর আলী।
কালবেলা : আপনার মূকাভিনয়ের যাত্রা কীভাবে শুরু হলো?
মীর লোকমান : ২০০৩ সালে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সর্বপ্রথম মূকাভিনয় দেখি। ততটা পরিশীলিত ছিল না সেটা, কিন্তু আমি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হই। এরপর ২০০৯ ও ২০১০ সালে পর্যায়ক্রমে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। মূকাভিনয়ের সাথে আরেকটু পরিচয় ও সম্পৃক্ততা তৈরি হয়। ২০১১ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে একটি কর্মশালায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে মূলত মূকাভিনয়ে আমার প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। ঐ বছরই ‘না বলা কথাগুলো না বলেই হোক বলা’ স্লোগান নিয়ে টিএসসিতে ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশন (ডুমা) প্রতিষ্ঠিত হয়।
কালবেলা : এতদিন ধরে এই শিল্পের সঙ্গে আছেন, দীর্ঘ এই যাত্রার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন?
মীর লোকমান : সত্যি বলতে মূকাভিনয় আমার ধ্যানজ্ঞান। মন্দ-ভালো মিলিয়ে লম্বা সময় কেটে গেছে। এই শিল্প আমার সত্তাকে চিনিয়েছে, ভিতরের মীর লোকমানকে আবিষ্কার করেছে। মানুষের মূকাভিনেতা হিসেবে প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছি, যা যা বলতে চেয়েছি, নির্বাক ভাষায় সবই বলতে পেরেছি।
কালবেলা : এই যাত্রায় কী কী বাধা-প্রতিবন্ধকতা পেয়েছেন এবং তা কীভাবে মোকাবিলা করেছেন?
মীর লোকমান : তুলনামূলকভাবে কম প্রচলিত হওয়ার কারণে শুরুতে কোনোরকম পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যায়নি, শোর অফারও মেলেনি খুব একটা। রাস্তাই ছিল আমাদের মঞ্চ। এরপর টিএসসি, নাটমণ্ডল, শিল্পকলা একাডেমি হয়ে আমরা ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও জায়গা করে নিই, অনেকবার প্রতিনিধিত্ব করি বাংলাদেশের। আমরা এখন বড় স্পন্সর পাই, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুদান পাই।
কালবেলা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাইম অ্যাকশন প্রতিষ্ঠা ও এর কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাই।
মীর লোকমান : কাজী মশহুরুল হুদার অধীনে এক কর্মশালা ও প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করি ২০১১ সালের জানুয়ারিতে। এরপর ২৭ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশন প্রতিষ্ঠা করি, তখন আমার বয়স অনেক কম। এরপর দীর্ঘ পথ চলা। আমি আসলে বর্তমানে এই সংগঠনের সাবেক কর্মী, তবে প্রশিক্ষক হিসেবে যুক্ত আছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীরাই এটি পরিচালনা করে। ঢাবির নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছরই নতুন কমিটি হয়। নিয়মিত কর্মশালা, প্রদর্শনী ও সেমিনার হয়, বছরে একবার আন্তর্জাতিক উৎসবের আয়োজন করে ডুমা। নানা আন্তর্জাতিক উৎসবেও অংশ নেয়।
কালবেলা : এখন বর্তমানে আপনি কী করছেন? মূকাভিনয় চর্চা কেমন চলছে?
মীর লোকমান : ২০২২ সালে দ্বিতীয় মাস্টার্স করার জন্য দক্ষিণ কোরিয়া যাই, এর আগেও অবশ্য পারফরম্যান্স করার জন্য দুবার যাওয়া হয়েছিল সেখানে। ইতোমধ্যে পড়াশোনার পাট শেষ। আর্টস ফেস্টিভ্যালের প্ল্যানার ও ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছি ওখানে। সত্যি বলতে মূকাভিনয়ই আমার কাছে সবকিছু। এর সাথেই আমার বসবাস।
কালবেলা : এখন তো আপনি দেশে আছেন, কাজও করছেন, ০৬ ফেব্রুয়ারির 'লাল মিছিল' এবং অন্যান্য ব্যস্ততা নিয়ে বলুন।
মীর লোকমান : ০৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে আমার ১১তম পূর্ণাঙ্গ একক মূকাভিনয় প্রদর্শনী ‘লাল মিছিল’ মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ের গণঅভ্যুত্থান আর বিশ্ব রাজনীতির নানা বিষয়কে উপজীব্য করে এই প্রযোজনা। সামনের মাসগুলোতে কোরিয়াতে কয়েকটি শো আছে, বছরের মাঝামাঝি সময়ে নিউজিল্যান্ড ও মরক্কোতে একাধিক প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়ার কথা আছে। এছাড়া বছরজুড়ে প্রফেশনাল শো তো থাকছেই।
কালবেলা : বাংলাদেশে মূকাভিনয় বর্তমানে কোন পর্যায়ে আছে বলে মনে করেন? অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু বলবেন কিনা?
মীর লোকমান : আমি বলব বর্তমানে ভালো কাজ হচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক মেধাবী তরুণ এখন মূকাভিনয়ের সাথে যুক্ত। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইম নিয়ে দারুণ আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমাদের অগ্রজদের বয়স হয়েছে, অনেকে বিদেশে আছেন, তারাও কাজ করছেন এবং অতীতে করেছিলেন বলেই আমরা মাইম নিয়ে জানতে পেরেছি। জোর দিয়ে আমি বলতে চাই, বাংলাদেশের মূকাভিনয়ের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। বহুমাত্রিক কাজ হতে যাচ্ছে সামনে। অন্যান্য শিল্পের মতোই মাইম বহুল পরিচিত ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবে শিগগিরই। ঢাকায় নিজস্ব জায়গায় ‘ইনস্টিটিউট অব মাইম অ্যান্ড মুভমেন্ট’ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে যাচ্ছে ।
কালবেলা : মূকাভিনয় মানুষ কেন দেখবে, শিখবে ও চর্চা করবে বলে মনে করেন?
মীর লোকমান : প্রথমত, মূকাভিনয় অন্যান্য শিল্পের মতোই স্বাভাবিকভাবে মানুষ দেখবে, শিখবে ও চর্চা করবে। দ্বিতীয়ত, এই শিল্প সহজে মানুষকে আকৃষ্ট করার সক্ষমতা রাখে। মানুষের কথাগুলো নির্বাক ভাষায় সমাজে বয়ান আকারে প্রতিষ্ঠার অসাধারণ শক্তি রয়েছে এই শিল্পের।
কালবেলা : দেশ, জাতি, মানবতা ও গণতন্ত্রের স্বার্থে মূকাভিনয় কী ভূমিকা রাখতে পারে আপনার মতে?
মীর লোকমান : আগেই বলেছি, মূকাভিনয় আসলে শিল্পের ভাষায় মানুষের কথাই বলে। দেশ ও জাতির প্রয়োজনে, সময়ের তাগিদে মূকাভিনয় রাজপথে থাকে অন্যায়ের মুখোমুখি সারিতে। গত এক যুগের উপরে বাংলাদেশ ও বিশ্বের নানা ক্রান্তিলগ্নে ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশন এবং অন্যান্য সংগঠন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। সামাজিক, রাজনৈতিক নানা অবিচার ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে মাইম শিল্পী হিসেবে আমরা সরব ছিলাম এবং তা চলমান থাকবে কালের প্রবাহে।
মন্তব্য করুন