ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও পরবর্তী সময়ের ঘটনাগুলোয় দেশের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মাঝে উদ্বেগ বেড়েছে। এর প্রভাব তাদের আচার-আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে। সে জন্য প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সরকারসহ সবার সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন বিশিষ্টজনরা।
রোববার (২০ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের সম্মেলন কক্ষে ‘প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন : আমাদের করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ‘গণসাক্ষরতা অভিযান' এবং ব্র্যাক শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।
সভার শুরুতে আলোচনাপত্রে জানানো হয়, প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে নির্বাচিত কিছু এলাকায় প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনভিত্তিক মতামত জরিপ গ্রহণ করেছেন গবেষণা দলের সদস্যরা। এর মধ্যে সারা দেশ থেকে দেড় শতাধিক সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-প্রতিনিধির মতামত গ্রহণ, বিভাগীয় পর্যায়ে একটি মতবিনিময় সভা ও জেলা পর্যায়ে ছয়টি এফজিডি এবং জাতীয় পর্যায়ে মতবিনিময় সভা রাখা হয়েছে।
সভায় জানানো হয়, সাম্প্রতিক আন্দোলন ও সহিংসতা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। পাশাপাশি, দেশের নানা এলাকায় আকস্মিক বন্যায় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের ‘ট্রমা’ দেখা দিয়েছে। এর কারণ হিসেবে গবেষণা বলছে, শিক্ষার্থীরা স্কুল ছেড়ে রাস্তায় নামা, মিছিল, সহিংসতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, মারামারি দেখা, রাজপথে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি ছোড়া দেখা বা শোনা এবং স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া ও কারফিউ ও অবরোধ কর্মসূচির কারণে ঘরে থাকার ফলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিবর্তনের ফলে স্কুলে না যাওয়ার প্রবণতা ও পড়ালেখার প্রতি অনীহা, ভয়-ভীতিতে থাকা, ঘুমের সমস্যা হওয়া ও দুঃস্বপ্ন দেখা, বিষণ্নতা ও হতাশাগ্রস্ত হওয়া, মোবাইল ফোনে আসক্ত হওয়া, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দেওয়া, সহিংস আচরণ করা, পাঠ্যবই বা শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন নিয়ে ভীতি-উদ্বেগ কাজ করার মতো প্রভাব দেখা গেছে।
এ ছাড়া শিশুদের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছবি ও খবর দেখে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হওয়া, শিশুসুলভ চঞ্চলতা হারিয়ে যাওয়া বা একাকিত্ববোধ সৃষ্টি হওয়া, বন্যার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতির হার বেড়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
সংকট সমাধানে মতবিনিময় সভায় বিভিন্ন পরামর্শ তুলে ধরেন সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নে বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ, শিশুদের সঙ্গে মতবিনিময়, উঠান বৈঠকের মাধ্যমে অভিভাবক ও সমাজের মুরুব্বিদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি, প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন, শিশুদের বিষণ্নতা, হতাশা কাটানোর জন্য বিনোদনমূলক পরিবেশ তৈরি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কাউন্সেলিং করার উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
সভায় জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য এবং শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, শিক্ষার্থীদের আগামীর দিনগুলোতে যেন মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যায়, সেজন্য কাজ করতে হবে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষার অংশীজনদের নিয়ে শিক্ষায় করণীয়ও ঠিক করতে হবে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহিত কামাল বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনায় প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়েছে। তাই শিশুদের কোনো কিছু করতে জোর করা যাবে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের মনের যত্ন নিতে মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিতের ওপরও জোর দেন তিনি।
সভায় সভাপতির বক্তব্যে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, সাম্প্রতিক আন্দোলন, বন্যা সহ নানা ঘটনা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে। শিক্ষার্থীরা ট্রমায় ভুগছে। শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হবে। সেজন্য মতবিনিময় সভা থেকে প্রাপ্ত প্রস্তাবগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরব।
মতবিনিময় সভায় অতিথি প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাইমারি এডুকেশন কনসাল্টেশন কমিটির সদস্য চৌধুরী মুফাদ আহমেদ, ব্র্যাক-আইইডির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. ইরাম মারিয়াম, টিচার ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর এম নাজমুল হক এবং বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজের সভাপতি শাহিনুর আল-আমিন।
শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক তপন কুমার দাশ। আলোচনাপত্র উপস্থাপন করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের কার্যক্রম ব্যবস্থাপক আব্দুর রউফ। এ ছাড়াও উপস্থিত অতিথিদের অংশগ্রহণে উন্মুক্ত আলোচনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, এসএমসি সদস্য, উন্নয়নকর্মী, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি, অভিযান সদস্য সংগঠন, এডুকেশন ওয়াচ, আইএনজিও, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
মন্তব্য করুন